ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি দৃঢ় মূর্তি। এক নারী, দুই পুরুষ। তিনজনই যেন এক অদম্য প্রতিজ্ঞায় বলছে, ‘আমরা হারিনি, হারবও না।’ এটাই ‘অপরাজেয় বাংলা’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতীকী চিহ্ন। যা শুধু ভাস্কর্য নয়, এক জাতির সাহস ও আত্মত্যাগের গল্প। ছয় ফুট উঁচু বেদির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই ভাস্কর্যের উচ্চতা ১২ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট ও ব্যাস ৬ ফুট। এখানে তিনজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি রয়েছে। এক গ্রামীণ যুবক, যার হাতে রাইফেলের বেল্ট। এটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এর মডেল ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র ও মুক্তিযোদ্ধা বদরুল আলম বেনু। দ্বিতীয়জন হাতে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, মুখে দৃঢ়তা। তার মডেল সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। নারী মূর্তিটি মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিয়োজিত নারীর প্রতীক, যার মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ। এই তিন প্রতিকৃতির মাধ্যমে ভাস্কর্যটি দেখিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে গঠিত এক ঐক্যবদ্ধ লড়াই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই ছিল মুক্তির সৈনিক। ১৯৭২-৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) তৎকালীন ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও জিএস মাহবুব জামানের উদ্যোগে এ ভাস্কর্যের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এর নামকরণ করেন মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, যিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ১৯৭৫ সালের পর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। চার বছর পর, ১৯৭৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পুনরায় পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়। অবশেষে ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবসের সকালে ‘অপরাজেয় বাংলা’ উদ্বোধন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি শুধু শিল্পকর্ম নয়, বরং এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা প্রতিটি প্রজন্মের কাছে এই ভাস্কর্য মনে করিয়ে দেয় স্বাধীনতার চেতনা, সংগ্রামের ইতিহাস, আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সাহস। ভাস্কর্যটির বেদিতে দাঁড়ানো তিন মুক্তিযোদ্ধার চোখে-মুখে যে দৃঢ়তা দেখা যায়, তা যেন গেয়ে ওঠে সমতার গান ‘অন্যায় ও বৈষম্য দূর করে আমরা গড়ব ন্যায়ের বাংলাদেশ।’ বর্তমানে ‘অপরাজেয় বাংলা’ ঢাবির অন্যতম ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশের স্থান হিসেবে এ স্থানটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। বরাবরই লড়াই সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে বিশেষ মর্যাদা এই ভাস্কর্যের। অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্য ছাড়া যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অপূর্ণ। প্রতিদিন অসংখ্য শিক্ষার্থী, গবেষক ও সাধারণ দর্শনার্থী এখানে আসেন, ছবি তোলেন, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। কারণ এ ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়ালে স্বাধীনতার অর্থ নতুন করে মনে পড়ে যায়। ‘অপরাজেয় বাংলা’ কেবল পাথরে খোদাই করা তিনটি মূর্তি নয়, এটি এক জাতির স্বাধীনতার প্রতীক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঘোষণা।