২০০৮ সালের আগেও বিভিন্ন হাটে চট পেতে বসে ধান কিনতেন সাধন চন্দ্র মজুমদার। সে ধান গরুর গাড়িতে করে বিভিন্ন মোকামে পৌঁছে দিতেন। এভাবেই হয়ে ওঠেন ধান-চালের ব্যাপারী। আশির দশকে নিজ এলাকা নওগাঁর নিয়ামতপুরে একটি ধান ভাঙার কল বসান সাধন চন্দ্র মজুমদার। এরপর আস্তে আস্তে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৪ সালে প্রথমে হাজীনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং পরে নিয়ামতপুর উপজেলা চেয়ারম্যান হন। ২০০৮ সালে প্রথমবার নওগাঁ-১ (নিয়ামতপুর-পোরশা-সাপাহার) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর টানা চারবার হয়েছেন সংসদ সদস্য। হাজীনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের দুবারের খাদ্যমন্ত্রী। ১৯৫০ সালে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার শিবপুর বলদাহঘাট গ্রামে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম সাধন চন্দ্র মজুমদারের। বাবা মৃত কামিনীকুমার মজুমদার ছিলেন শিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সে সময় যোগাযোগব্যবস্থা ভালো ছিল না। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে নিয়ামতপুরে যেতে হতো সাধারণ মানুষকে। তখন কোনো যানবাহন ছিল না। নৌকা, হাঁটা, সাইকেল, ঘোড়ার গাড়ি বা গরুর গাড়িই ছিল চলাচলের অন্যতম মাধ্যম। একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম বলতে যা বোঝায়, তা-ই ছিল নিয়ামতপুর উপজেলা।
নওগাঁর বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে ও পারিবারিকভাবে জানা যায়, ১/১১-এ রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে ২০০৮ সালে পোরশা, সাপাহার ও নিয়ামতপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত নওগাঁ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাধন চন্দ্র মজুমদার। এর আগে এ আসন থেকে আরও দুবার নির্বাচন করেও বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে যান তিনি। মূলত ১/১১-এর পট পরিবর্তনই তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসে।
সাধন চন্দ্র মজুমদারের নির্বাচনি এলাকায় মানুষের মুখে মুখে এখন ধান ব্যবসায়ী হয়েও তাঁর অঢেল সম্পদ আর টাকার গল্প। মানুষের প্রশ্ন-কীভাবে তিনি রাতারাতি এত টাকার মালিক হলেন?
বদলিবাণিজ্য, চালের বাজারের সিন্ডিকেট, টেন্ডারের কমিশন, জলমহাল দখল, আধিপত্য বিস্তারসহ ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় আয় করেছেন শত শত কোটি টাকা। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুবাদে সড়ক বিভাগ, এলজিইডি, কৃষি বিভাগ, খাসপুকুর, সরকারি জমি ও বিভিন্ন নিয়োগবাণিজ্য ছিল তাঁর দখলে। পরিবারের সদস্যরা তাঁর ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে জেলায় গড়ে তোলেন মজুতদারির সাম্রাজ্য।
ছোট ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা ছিলেন সিন্ডিকেটের মূলহোতা। সাধন মজুমদারের মেয়ে সোমা মজুমদার, কাবেরী মজুমদার, কৃষ্ণা মজুমদার, তৃণা মজুমদার, তিন জামাতা আবু নাসের বেগ (মাগুরার সাবেক ডিসি), নাসিম আহম্মেদ (নওগাঁ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) ও শোভন দাস (পেশা পাইলট), তাঁর ভাতিজা রাজেশ মজুমদার, সিলেটের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক সাইফুল ইসলাম, দিনাজপুরের পুলহাট খাদ্য গুদামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুস সালাম মিলে গড়ে তোলেন প্রতাপশালী সিন্ডিকেট। টাকার বিনিময়ে সব ধরনের অনিয়ম নিয়মে পরিণত করত এ সিন্ডিকেট। আর এ সিন্ডিকেটের গ্রিন সিগন্যাল পেলে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার কোন পদে কাকে কোথায় পদায়ন করতে হবে সেই আদেশ দিতেন।
রাজশাহী বিভাগের বদলি, পদায়নের টাকা আসত সরাসরি মনোরঞ্জন মজুমদার মনার কাছে আর রংপুর বিভাগের বদলি, পদায়নের টাকা আসত দিনাজপুরের পুলহাট খাদ্য গুদামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুস সালামের মাধ্যমে। বিনিময়ে সিন্ডিকেটের সদস্য আবদুস সালাম কয়েক কোটি টাকা খরচ করে নওগাঁর সেবাশ্রমপাড়ায় গড়ে তুলেছেন সাত তলা ভবন। প্রতি ফ্লোরে দুটি ইউনিট আছে।
সাধনের মন্ত্রিত্বকালে সিন্ডিকেট ঠিক রাখার জন্য যখন যাকে যেখানে প্রয়োজন সেখানে লোভনীয় পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। যার কারণে তদবিরবাণিজ্যের সুবিধার্থে খাদ্য পরিদর্শক আবদুস সালামকে নওগাঁর মহাদেবপুর থেকে বদলি করা হয় দিনাজপুরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য গুদাম পুলহাটে। খাদ্যমন্ত্রীর এ সিন্ডিকেট পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বশেষ গত বছরে (এপ্রিল-মে) কোটি টাকার বিনিময়ে কুমিল্লা থেকে দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে সুবীরনাথ চৌধুরী এবং ২০ লাখ টাকায় নওগাঁর মহাদেবপুর খাদ্য গুদামে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে জাহেদুর রহমানকে পদায়ন করে। এ ছাড়া ২০ লাখ টাকায় নওগাঁ সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক গোলাম মওলা, সাধন চন্দ্র মজুমদার খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমে ৫০ লাখ টাকায় বগুড়ার সান্তাহার সিএসডির ম্যানেজার পদে দুলাল উদ্দিন খান, তারপর ৫০ লাখ টাকায় হারুনুর রশিদকে সান্তাহার সিএসডির ম্যানেজার পদে পদায়ন করা হয়। ফরিদপুরের অম্বিকাপুর খাদ্য গুদামের এসএমও বিকাশ চন্দ্র প্রামাণিককে পদায়ন করা হয় ৩০ লাখ টাকায়। এর আগে বিকাশ চন্দ্র প্রামাণিক ৫০ লাখ টাকা খরচ করে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি সিএসডির ম্যানেজার পদে দুই বছর চাকরি করেন। ৫০ লাখ টাকায় দিনাজপুর সিএসডির ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন, পাবনার ঈশ্বরদী এলএসডির এসএমও হিসেবে ৩০ লাখ টাকায় মিজানুর রহমান কাঞ্চন, ঈশ্বরদীর মুলাডুলি সিএসডির ম্যানেজার হিসেবে ৫০ লাখ টাকায় আবদুল হান্নানকে পদায়ন করা হয়। এ ছাড়া খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ৫০ লাখ টাকায় দিনাজপুরের পুলহাট খাদ্য গুদামে আবদুস সালাম দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ৫০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ভবতোষ কুমার বিশ্বাস পুলহাটে বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করছেন। বগুড়া সদর খাদ্য গুদামে ৩০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ইউসুফ আলী, তালোড়া খাদ্য গুদামে ২০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে তন্ময় কুমার বিশ্বাস, সান্তাহার খাদ্য গুদামে ২০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আজিজুল ইসলাম. নওগাঁ সদর খাদ্য গুদামে ৫০ লাখ টাকায় সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদ রানা (বর্তমানে টেকনিক্যাল ইন্সপেক্টর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ) দায়িত্ব পান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর খাদ্য গুদামে ৩০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আবু এরশাদ দায়িত্ব পান। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের সঠিক হিসাব দিতে না পারায় তাঁর নামে দুদকেও মামলা চলছে।
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার সরস্বতীপুর খাদ্য গুদামে ২০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে পরেশ চন্দ্র মাহাতো, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি খাদ্য গুদামে ২০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে শাহনাজ পারভীন দায়িত্ব পান। গত সাড়ে পাঁচ বছরে এ রকম শতাধিক পোস্টিং দিয়েছে সাধন মজুমদারের পারিবারিক এ সিন্ডিকেট।
আবার টাকা খেয়েও কাজ করেননি এমন বিস্তর অভিযোগ আছে সাধন চন্দ্রের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী নিয়ামতপুর উপজেলার ব্যবসায়ী আবুল কাশেম বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে পদায়নের কথা বলে খাদ্যমন্ত্রীর ভাই মনা মজুমদার ৩০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। গত পাঁচ বছরেও পদায়ন হয়নি। টাকাও ফেরত পাইনি। একদিন টাকা চাইতে গেলে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, কেটে পানিতে ভাসিয়ে দেবেন।’ ভয়ে আর টাকা চাইতে যাননি তাঁরা।
সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের গত দুই সংসদ নির্বাচনে দেওয়া হলফনামা থেকে জানা যায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি হলফনামায় কৃষি খাত থেকে বার্ষিক আয় দেখান ৩০ হাজার টাকা। কৃষিজমির পরিমাণ দেখান লিজসহ ২৩ বিঘা। ব্যবসা থেকে আড়াই লাখ টাকা। শেয়ার, সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানত (এফডিআর) দেখান ৪৯ লাখ টাকা। নিজ নামে ব্যাংকে নগদ টাকা দেখান ২১ লাখ ৪১ হাজার ৮০৫ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা অর্থ ছিল ১০ লাখ ৫০০ টাকা। পোস্টাল, সেভিংস, সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ ৩৯ লাখ টাকা। গাড়ি ছিল দুটি। একটির দাম ১৬ লাখ ৩০ হাজার, অন্যটি (এমপি হিসেবে করমুক্ত সুযোগে) ৪১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। বিয়ে সূত্রে পেয়েছেন ১২ ভরি সোনা। এ হলফনামায় তিনি সই করেন ২ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে।
আবার ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাদ্যমন্ত্রী হলফনামায় কৃষি খাত থেকে বার্ষিক আয় দেখান ৩৫ হাজার টাকা। ব্যবসা থেকে ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। শেয়ার, সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানত (এফডিআর) দেখান ১ কোটি ৮৮ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। নিজ নামে ব্যাংকে নগদ গচ্ছিত দেখান ১ কোটি ৭৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা অর্থ ছিল ২৪ লাখ ৬০ হাজার ৫০০ টাকা। পোস্টাল, সেভিং, সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ ৭৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭৮৩ টাকা। ওই নির্বাচনের সময় মাত্র একটি গাড়ির তথ্য হলফনামায় তুলে ধরেন। হলফনামামতে গাড়িটির মূল্য ৬৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭৪২ টাকা। গত দুই সংসদ নির্বাচনেও ১২ ভরি স্বর্ণই দেখিয়েছেন। জমিও লিজসহ ২৩ বিঘাই দেখিয়েছেন। এ ছাড়া ১১ কাঠার একটি অকৃষি জমির কথা বলা হয়েছে, যার মূল্য ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩২ টাকা। তবে ২০১৩ সালের হলফনামায় মার্কেন্টাইল ব্যাংক নওগাঁ শাখা থেকে সিসি ঋণ দেখান ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪৮ টাকা। পরের নির্বাচনে তিনি এ ঋণটি সমন্বয় দেখান। ২০১৮ সালের হলফনামায় তিনি ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা সংসদ সদস্য হিসেবে সম্মানি ভাতা পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। আয়ের উৎস অন্যান্য/এফডিআর থেকে প্রাপ্ত সুদ হিসেবে দেখান ৪ লাখ ১০ হাজার ৫০৯ টাকা। এর আগের নির্বাচনে হলফনামায় সেটা দেখানো হয়নি। ফ্রিজ একটি, ফ্যান তিনটি, খাট দুটি, ড্রেসিং টেবিল একটি, ডাইনিং টেবিল একটি দেখানো হলেও এসির হিসাব দেননি।
স্থানীয়রা জানান, এসব তো কাগজে কলমের হিসাব। তবে তাঁর জীবনযাত্রা ছিল তার চেয়ে কয়েক গুণ ব্যয়বহুল। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের হলফনামার হিসাব ধরলেও তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক। এক সংসদ নির্বাচন থেকে অন্য সংসদ নির্বাচনের মধ্যকার সময়েও তাঁর হাজার কোটি টাকার সম্পদের দেখা মেলে। দুই নির্বাচনের হলফনামায় এসব সম্পদ দৃশ্যমান হলেও অদৃশ্য সম্পদ কত আছে সে প্রশ্ন মানুষের মুখে মুখে।