বিভিন্ন সময় দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলো নানা রকম আশ্বাস দিলেও এতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। সামগ্রিক এ কার্যক্রমে চলছে ধীরগতি। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের ১১ মাসেও টাকাও ফেরত আসার কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলোকে বারবার চিঠি লিখেও কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
নির্বাচনের আগে টাকা পাচারের ঘটনা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবার নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার হলে বাইরের দেশ থেকেও দেশের অভ্যন্তরে কালো টাকা আসতে পারে। অর্থবিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, এ দেশ থেকে অন্য এক দেশে যাওয়ার পরে সেই দেশ থেকে নিরাপদ তৃতীয় কোনো দেশে টাকাগুলো পাচার করা হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ থেকে সরাসরি শেষ গন্তব্যে টাকা পৌঁছায়নি। এ জন্য যে কোনো বিদেশি কোর্টে এসব টাকা বাংলাদেশ থেকে এসেছে তা প্রমাণ করা কঠিন। এমনকি পাচার হওয়া অর্থ কোন কোন দেশে রয়েছে- এ বিষয়ে কোনো সংস্থা বা দেশের কাছ থেকে পরিষ্কার কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে ইতোমধ্যে বিদেশি ল ফার্ম নিয়োগ করা হয়েছে। আমরা সমন্বয় করে কাজ করছি। এটা সময়সাপেক্ষ। কারণ আমরা এ ধরনের সমস্যা আগে ফেস করিনি। এটা শুধু দেশের আইনে হবে না, বিদেশিদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। এসব অর্থ ফেরত আনতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। তবে আমরা চেষ্টা করে চলেছি। এখানে আমাদের অগ্রগতিও আছে। আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) থেকে গ্লোবাল ইন্টিগ্রিটি জিএফআই থেকে বারবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। এমনকি সুইজারল্যান্ড ইউকে ইউএসেতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একাধিক বৈঠকও করেছেন কিন্তু কার্যকর কোনো ফলাফল এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তারা বলছেন বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা যেসব দেশে গেছে সে টাকা সেখানে বিনিয়োগ হয়েছে। সেজন্য সেই দেশও সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে না যা খুবই হতাশাজনক।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে অন্তত পাঁচটি ধাপ অনুসরণ করতে হবে। যা অনুসরণ করতে বাংলাদেশের আরও কয়েক বছর এমনকি দশকের পর দশকও লেগে যেতে পারে। প্রথমত অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা, দ্বিতীয় ধাপে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ, তৃতীয় ধাপে, সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে অভিযোগ তদন্ত ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আদালতে মামলা করা, চতুর্থ ধাপে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পাচারকারীর বিরুদ্ধে দেশের আদালতের রায় এবং শেষ ধাপে টাকার গন্তব্য দেশের আদালতে আন্তর্জাতিক আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা করে পাচারকারীর বিরুদ্ধে রায় এলেই অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। সূত্র জানায়, এসব ধাপের প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীটি প্রায় সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ। পাচারের সঙ্গে অভিযুক্ত অনেক ব্যক্তির নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। অনেককে চিহ্নিতও করা হয়েছে। কিন্তু তাদের ব্যাপারে ঠিক কোনো তথ্য-প্রমাণ এখনো হাজির করা সম্ভব হয়নি। কারণ টাকাটা যে দেশে পাচার করা হয়েছে সে দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা সরকার সঠিক তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ করছে না। সূত্র জানায়, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের বয়স ৯ মাস পেরিয়ে গেছে। টাস্কফোর্সসংশ্লিষ্টরা বলছেন পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা মোটেও সহজ কাজ নয়। কোনো দেশই টাকা ফেরত আনতে পারেনি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সিস্টেম আরও জটিল। তবে গত ৯ মাসে জব্দ করা হয়েছে দেড় সহস্রাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। এবং এসব হিসাবের বিপরীতে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা মূল্যের অর্থ ও শেয়ার শনাক্ত করা হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে এখনো অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতিই সম্পন্ন হয়নি। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে গঠন করা হয়েছে ‘স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি টাস্কফোর্স’। তারা একটা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে। তারপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এরই মধ্যে আড়াই শতাধিক তদন্ত রিপোর্ট সিআইডি ও দুদকে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২০টির অডিট রিপোর্ট সম্পন্ন হয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে মামলা করা শুরু করেছে দুদক। অভিযুক্তদের সবাই বিগত সরকারের আমলে অবৈধ সুবিধা নেওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে টাস্কফোর্স। ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়েছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেগুলো চিহ্নিত করা সত্যিই কঠিন কাজ। এটা ফেরত আনা তো আরও কঠিন।