ধরুন আপনি অন্ধকার একটি ঘরে বন্দি হয়ে পড়েছেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দ। তারপর নিশাচর পাখির ডানার ঝাপটানি। সঙ্গে এলোমেলো গরম বাতাস, যা ক্ষণে ক্ষণে আবার ঠান্ডা হয়ে আপনার শরীরে আঘাত করছে। এ অবস্থায় আপনি যদি দুর্বলচিত্তের মানুষ হন তবে কালবিলম্ব না করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন। আর আপনি যদি সাহসী মানুষ হন, তবে ভয় আতঙ্ক ভাবনা অস্থিরতা ইত্যাদি সত্ত্বেও বেঁচে থাকার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করবেন। আর সেই সময় যদি বলা হয় এই মুহূর্তে আপনাকে প্রকৃতির কোন উপকরণটি দিলে আপনি সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন। আপনি যদি খুব অল্প বুদ্ধির মানুষও হন তবে সঙ্গে সঙ্গে বলবেন- আলো চাই- দেখতে চাই আমি কোথায় কী অবস্থায় আছি।
আলোর প্রত্যাশায় মানুষের চিরায়ত আকুতির নামই জ্ঞান, যা অন্ধকার দূর করে আপনাকে আলোর পথে নিয়ে যায়। যেখানে জ্ঞান নেই সেখানেই ভয়। যেখানে জ্ঞান নেই সেখানেই অন্ধকার। আর অন্ধকারেই ঘটে তাবত দুর্ঘটনা। এজন্য মানবের শুরুটি হয়েছিল জ্ঞান অর্জনের নিরন্তর প্রচেষ্টার মাধ্যমে। মানুষ জানতে চেয়েছে, বুঝতে চেয়েছে এবং অজানাকে আবিষ্কার করেছে। সহজাত বুদ্ধির সঙ্গে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-দক্ষতা যুক্ত হতে হতে আদিম পৃথিবী থেকে আধুনিক বিশ্বে মানবের উন্নয়নের সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হয়ে ওঠাও জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। মানুষের জীবনযাত্রা-চিন্তাচেতনার সব স্তরে জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন উন্নত জাতি গঠনের পূর্বশর্ত তদ্রুপ রাষ্ট্র গঠন, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং রাজনীতিতে জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার যেখানে যত বেশি উন্নত হয়েছে সেখানেই সভ্যতার নিত্যনতুন ইতিহাস রচিত হয়েছে।
আমাদের জাতীয় জীবনে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা সম্ভবত এশিয়ার সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। অন্যদিকে রাজনীতিতে এখন জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা রীতিমতো গুরুতর অপরাধ। এখানে প্রশ্ন করাকে মনে করা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ। জবাব চাওয়া মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ এবং ন্যায়বিচার-স্বচ্ছতা এবং স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাওয়া অন্ধকার যুগের প্রাগৈতিহাসিক ধ্যানধারণা। চলমান সমাজে জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ অথবা অ্যানিমাল ফার্মের কাহিনির প্রেক্ষাপটগুলো যেভাবে মাঠে-ময়দানে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে করে ১৯৮৪-এর সেই অমর বাণী- ‘বড় ভাই তোমাকে নজরে রাখছেন (Big Brother is Watching You)।’ যন্ত্রণা মানুষকে কীভাবে অন্ধকারজগতে নিয়ে যাচ্ছে তার টাটকা উদাহরণ হলো প্রখ্যাত সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের লাশ মেঘনা নদীতে ভাসছিল।
জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসের আরেকটি বিখ্যাত উক্তি হলো- যারা অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারাই ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করে। আর যারা বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তারা মূলত অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সাম্প্রতিক উত্থান এবং সাম্প্রতিককালে সাবেক ফ্যাসিবাদের কালো থাবার ভয়ানক আক্রমণের কথা ১৯৪৬ সালে কীভাবে জর্জ অরওয়েল চিন্তা করেছিলেন তা ভাবলে শরীরমন শিহরিত হয়ে ওঠে। এই উপন্যাসের আরেক দুনিয়াকাঁপানো উক্তি হলো- যুদ্ধই শান্তি এবং স্বাধীনতা মানেই দাসত্ব। মানুষের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, অজ্ঞতাই শক্তি (Ignorance is strength)।
জর্জ অরওয়েলের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সত্যজিত রায় তাঁর হিরক রাজার দেশে সিনেমায় বলেছেন- ‘যত বেশি জানে- তত কম মানে।’ সুতরাং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ- নষ্ট কর সব বইপুস্তক আর লোকদের ধরে এনে মগজ ধোলাই কর যেন তারা বলে- বাকি রাখা খাজনা মোটেও ভালো কাজ না, ভরপেট না ও খাই, রাজকর দেওয়া চাই। যায় যদি থাক প্রাণ, হিরকের রাজা ভগবান। অনাহারে নাহি খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ। লেখাপড়া করে যে অনাহারে মরে সে। জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই। বিদ্যা লাভে লোকসান, নাহি অর্থ নাহি মান। হিরক রাজা বুদ্ধিমান, করো সবই তারই জয়গান।
হিরক রাজার দেশের কাহিনি ছেড়ে চলুন এবার জর্জ অরওয়েলের অ্যানিমাল ফার্ম অর্থাৎ পশুদের খামার থেকে ঘুরে আসি। উপন্যাসটির মূল কাহিনি হলো খামারের পশুরা একসময় তাদের মালিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিদ্রোহ করে বসে এবং দেশের সব খামারের পশুরা মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পশুরা যাকে সেনাপতি নিয়োগ করে সে ছিল বয়োবৃদ্ধ এক শুয়োর। এই যুদ্ধে পশুরা অসাধারণ কতগুলো নীতিবাক্য প্রচার করতে থাকে আর সেগুলো হলো- যে দুই পায়ে চলে সে শত্রু। যে চার পায়ে চলে বা যার ডানা আছে সে বন্ধু। কোনো প্রাণী পোশাক পরবে না। কোনো প্রাণী বিছানায় ঘুমাবে না। কোনো প্রাণী মদ্যপান করবে না। সব প্রাণী সমান।
পশু বিদ্রোহের ফলে পরিস্থিতি কেমন হয়েছিল, তার কিছু বর্ণনা দিয়ে আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা করব- পশু খামারের সাত অধ্যায়ে জর্জ অরওয়েল বলেন, তারা এমন একসময়ে এসে পৌঁছেছিল যখন কেউ তার মনের কথা বলতে সাহস পেত না। যখন হিংস্র গর্জনকারী কুকুর সর্বত্র ঘুরে বেড়াত এবং যখন আপনাকে দেখতে হতো আপনার সহকর্মীদের ভয়ংকর অপরাধ স্বীকার করার পর টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা। পশুরা নির্বিচারে এসব কর্ম করার যে যুক্তি দেখাত তা হলো একসময় তারা দাস ছিল এবং এখন তারা স্বাধীন আর এটাই তাদের সব কর্মের দলিল।
উল্লিখিত ঘটনার আলোকে আপনি যদি বর্তমান জমানা মূল্যায়ন করেন তবে হিরক রাজার দেশে কিংবা ১৯৮৪ এবং অ্যানিমাল ফার্মের কল্পকাহিনির সঙ্গে চলমান রাজনীতির একটি তুলনামূলক চালচিত্র অনুধাবন করতে পারবেন। বর্তমান রাজনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হলো- আমরা জানি না কারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, নীতি-আদর্শ এবং গন্তব্য সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। প্রতিমুহূর্তে যা ঘটছে তা একটু পরে নতুন ঘটনা দ্বারা হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির আকাশে সকালে যদি সিঁদুরে মেঘ দেখি তবে দুপুরে দেখা দেয় কালবৈশাখির কালো মেঘ। বিকালে কোনো রকম তর্জন গর্জন ছাড়াই সেই কালো মেঘ সরে গিয়ে সাদা মেঘের ভেলা উড়তে থাকে। তারপর সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে শুরু হয় তপ্ত রোদের দহন এবং নিশাত সূর্যের দেশের মতো মধ্যরাত অবধি রাজনীতির উত্তাপ এবং দহনে ভূমি-বাতাস-পাহাড়-বনজঙ্গল-প্রাণিকুল পানি পানি বলে হাহাকার করে এবং ভোর রাতে শুরু হয় কুয়াশার যন্ত্রণা।
রাজনীতির আকাশের মতো বাংলার রাজনীতির বাতাস মানুষকে হরহামেশা জ্বালাযন্ত্রণা দিতে থাকে। বাতাসে ভেসে বেড়ায় নানা গুঞ্জন। সঙ্গে অদ্ভুত সব দুর্গন্ধ। রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে পরিমাণ অক্সিজেন দরকার তা কর্পূরের মতো উবে যায় ঊর্ধ্বলোকে। মূর্খ, অজ্ঞ, চিত্তহীন, জ্ঞানহীন নিম্ন জাতের প্রাণীদের শ্বাসপ্রশ্বাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসের অক্সিজেন তাড়িয়ে দেয়। ফলে রাজনীতিসচেতন মানুষের নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসে অক্সিজেনের সিলিন্ডার খোঁজার জন্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানদ্বারে উঁকিঝুঁকি মেরে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কোনোমতে বেঁচে থাকার লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। আকাশবাতাসের মতো রাজনীতির পথও ভয়ানক হয়ে উঠেছে দিনকে দিন। চারদিকে শুধু কুয়াশা। ফলে এক গজ দূরে কী ঘটছে কী হচ্ছে বা কে দাঁড়িয়ে আছে, তা রাজনীতির পথচারীরা দেখতে পাচ্ছেন না। রাজনীতির পথ ক্রমশ কাদামাটিতে পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে এবং খানাখন্দে এতটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে যে পথচারীরা পা ফেলতেও ভয় পাচ্ছে। ফলে পথ যেন আর শেষ হচ্ছে না এবং গন্তব্যে পৌঁছার আশা- আকাঙ্খা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়ছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক