বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে টানা আট দিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সমর্থকরা। আন্দোলন কর্মসূচিতে অন্তর্বর্তী সরকারের এক উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এতে পাল্টা বক্তব্যও এসেছে। ইশরাক বলছেন, দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। সরকারের দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। অন্তত পাঁচজন উপদেষ্টা এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি কথা বলেছেন। মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা রিটের ওপর আদেশ গতকাল পিছিয়ে আজ দিন রেখেছেন হাই কোর্ট। মেয়রের এ ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে বিএনপির। দলটির শীর্ষ নেতারা সরকারের কঠোর সমালোচনা করছেন। এদিকে ইশরাকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে আলোচিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। অন্য দলগুলোও এ বিষয়ে রয়েছে সরব। সব মিলিয়ে মেয়র ইস্যুতে রাজনীতি ভিন্ন মোড় নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের দাবিতে জুলাই গণ অভ্যুত্থানে একযোগে মাঠে থাকা বিএনপি ও এনসিপি নেতাদের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে কথার লড়াই চলছে। একে অন্যকে অনেকটা আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলায় দুই দলের সম্পর্ক ক্রমেই তিক্ততার দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপির প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা না করার ইস্যু কেন্দ্র করে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। আইনি জটিলতার কথা বলে ইশরাকের শপথ নেওয়ার সুযোগ নেই, সাফ জানিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। অন্যদিকে শপথ নিতে অনড় ইশরাক হোসেনের জন্য প্রয়োজনে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিচ্ছে বিএনপি। দাবি উঠছে উপদেষ্টা আসিফের পদত্যাগের। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে রাজনীতির মাঠে অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কা সাধারণ মানুষের।
বিএনপি যখন গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুলছে তখন এনসিপি রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নির্বাচনের বিরোধিতা করছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের কথা বলছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনপি ও তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশ পরিচালনায় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী শুরুর দিকে একাধিক প্ল্যাটফর্মে একই সুরে কথাও বলেছেন বিএনপি ও ছাত্রনেতারা। তবে নির্বাচনের দাবি নিয়ে বিএনপি সরব হওয়ার পর দূরত্ব বাড়তে থাকে। ক্রমেই দুই দলের নেতারা নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো বাগ্যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সবশেষ ইশরাকের শপথ গ্রহণের ইস্যু কেন্দ্র করে এ বাগ্যুদ্ধ প্রকট আকার ধারণ করছে। শুধু ইশরাকই নন, বিএনপির শীর্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরাও উপদেষ্টা আসিফ এবং এনসিপি নেতাদের জড়িয়ে কথা বলেন। পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের ভূমিকার কথা তুলে ধরে এনসিপির শীর্ষ নেতা আবদুল হান্নান, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলমরা ফেসবুকে পোস্ট করেন। জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা এসব ছাত্রের ভূমিকার কথা বলে আইন উপদেষ্টাও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল যখন নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে কথা বলছে তখন ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আত্মপ্রকাশ করা এনসিপি ভিন্ন সুরে কথা বলছে। নতুন এ রাজনৈতিক দল দ্রুত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে। জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণপরিষদ নির্বাচনেরও দাবি করছে। একই সঙ্গে গণপরিষদের মাধ্যমে ‘নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ স্থিতিশীল করার পরিবর্তে এসব দাবি তুলে মূলত এনসিপি নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। এতে সরকারের মদদ আছে এমন অভিযোগও করা হচ্ছে।
ইশরাকের অনুসারীদের আন্দোলন নিয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সোমবার বলেন, গায়ের জোরে নগর ভবন বন্ধ করে বিএনপি আন্দোলন করছে। ইশরাকের শপথ নিয়ে জটিলতা নিরসন না করা পর্যন্ত শপথ গ্রহণ সম্ভব নয় বলেও সাফ জানিয়েছেন তিনি। আসিফের সুরে কথা বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। ইশরাকের উদ্দেশে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যে নির্বাচন অবৈধ, সেই নির্বাচনের মেয়র আমি কীভাবে হতে চাই? সেটা কীভাবে বৈধ হয়? তাহলে তো সেই নির্বাচনকে আমি বৈধতা দিয়ে দিচ্ছি।’ এর পরই পাল্টে যায় চিত্র। সরকারে থাকা কতিপয় ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করে ইশরাক ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ইশরাকের মেয়র পদ ঘিরে রাজনীতি ভিন্ন মোড় নিচ্ছে। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস বিএনপির ইশরাক হোসেনকে প্রায় পৌনে ২ লাখ ভোটে পরাজিত করেন। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২৭ মার্চ বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে রায় দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল। আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইশরাকের শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাঁকে দায়িত্ব না দেওয়ায় রাস্তায় নেমেছেন তাঁর সমর্থকরা। তাঁদের অভিযোগ, ফল জালিয়াতি করে ইশরাককে পরাজিত করা হয়েছিল। আদালতের রায়ে তিনি মেয়র পদ ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু টালবাহানা করে তাঁকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া বা শপথ পড়াচ্ছে না স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া শপথ না পড়ানোর কারণ ফেসবুকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আর ইশরাক হোসেন অন্তর্বর্তী সরকারের সব দায়িত্ব থেকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। সমর্থকদের সঙ্গে রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়ে ইশরাক হোসেন বলেন, ‘আন্দোলনকারী জনতার প্রতি সর্বাত্মক সংহতি জানাতে এবং তাদের সঙ্গে যতদিন প্রয়োজন রাজপথে সহাবস্থান করার জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই হাজির হব ইনশা আল্লাহ।’