বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ দেখছেন না বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৫-২৬ : নীতি সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক বহুপক্ষ অংশীজনের এ সেমিনার যৌথভাবে আয়োজন করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
‘জাতীয় বাজেটের শৈল্পিক বিশ্লেষণ : আদৌ কিছু পরিবর্তন হবে কি’ শীর্ষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের উপস্থাপিত প্রবন্ধে আসন্ন বাজেটের প্রেক্ষাপট, প্রবৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি, রাজস্ব কাঠামো, স্থিতিশীলতার রূপরেখা ও সামাজিক সুক্ষায় অগ্রাধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। সরকার কৌশল নিয়েছিল; কিন্তু সামান্য কিছু পরিবর্তন ছাড়া আর কিছু দেখছি না। আলোচনায় অর্থনৈতিক সংস্কারে সহযোগিতা ও স্বচ্ছতার অভাব আছে বলে অভিযোগ করেন ড. দেবপ্রিয়। এ ছাড়া তিনি মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে অন্যান্য সংস্কারে যতটুকু মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে, অর্থনীতির সংস্কারে ততটুকু হচ্ছে না। অর্থনৈতিক সংস্কার না হলে কোনো কিছুই স্থিতিশীল থাকবে না। এনবিআর প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় বলেন, এনবিআরকে দুই ভাগের সিদ্ধান্ত সঠিক। তবে প্রক্রিয়া যথাযথভাবে হয়নি। আলোচনা ছাড়া পেশাজীবীদের জায়গা সংকুচিত করে যা করা হয়েছে, সেটা ঠিক হয়নি। এখন ঠিক করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাজেটে ব্যয়ের তথ্য উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, বাজেটে রাজস্বের ৭৫ শতাংশ বিদেশি ঋণের সুদ ও বিভিন্ন খাতের ভর্তুকিতে চলে যাবে। বাকি টাকা চলে যাবে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন দিতে। রাজস্ব থেকে দেশের উন্নয়ন খাতে ব্যয় করতে কোনো অর্থ থাকবে না।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় এসডিজির সদস্য ও সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাচার করা অর্থ বিভিন্নভাবে ফেরত আনার চেষ্টা করতে হবে। অবৈধ পথ বন্ধ হওয়ায় এক মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রায়হান বলেন, বড় কোনো বিচ্যুতি ঘটবে না বলে আশা করি। তবে বাংলাদেশের সব ব্যাংকে কী কী কার্যক্রম হচ্ছে সেগুলোর ইনফরমেশন কি কারও কাছে আছে? এখানে লুকোচুরি হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীদের যেসব ব্যাংক ছিল, সেখানে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। সে সংকট কিছুটা কাটলেও পুরোপুরিভাবে কাটেনি। ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. মো. তামিম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানির আমদানি নির্ভরতা থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। ২০২৯-৩০ সালে আমরা ঘাটতিতে পড়ব। গ্যাস খাতও বিপর্যয়ে পড়বে। নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনে বাজেটে বেশি বরাদ্দ দিতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিডস) মহাপরিচালক ড. এ কে এনামুল হক বলেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সিএসআর এর বাজেট বা খরচ যেন মানবিক উন্নয়নমূলক কাজেও ব্যয় করা হয়। অর্থাৎ তারা যেন করপোরেট লাভের বাইরে সমাজের জন্য অবদান রাখে। অভিবাসন বিষয়ক গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান রামরুর চেয়ারপারসন ড. তাসনিম এ সিদ্দিকি বলেন, আসন্ন বাজেটে অভিবাসীদের বিষয়ে ভালো কিছু থাকবে বলে আশা করি। বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। দক্ষ নারী কর্মী তৈরি করা উচিত।
বিজনেস ইনেশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, আমরা আশা করছি, এবারের বাজেটে এমন কিছু থাকবে যেটা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে। আমরা একটি সুশৃঙ্খল বাজেট দেখতে চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবু ইউসুফ বলেন, বাজেটে দেশের তরুণদের বিষয় সামনে রেখে কর্মসংস্থানকে সবার আগে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এরপর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। বিদেশি ঋণ কমাতে রাজস্ব বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি। বিডসের গবেষণা পরিচালক ড. কাজী ইকবাল বলেন, দেশে বেকারত্বের হার দিনদিন বাড়ছে। শ্রমবাজারে অবস্থা খারাপ হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক শারমিন নিলোর্মি বলেন, আমাদের খুব আশা ছিল শিক্ষা কমিশন করা হবে। তবে সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। স্কুল শিক্ষকদের বেতন-কাঠামো নিয়ে বাজেটে আলাদা কিছু থাকা উচিত।
সেমিনারে আরও আলোচনা করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন।