আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ তিন দফা দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে চলছে ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচি। প্রথম দিনের ‘শাহবাগ ব্লকেড’ কর্মসূচির পর গতকাল দ্বিতীয় দিনে বেলা ৩টায় শুরু হয় পূর্বঘোষিত গণজমায়েত।
‘ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য’-এর ব্যানারে গণজমায়েতে অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মী। বক্তব্য, প্রতিবাদী গান, কবিতা আর স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা শাহবাগ এলাকা।
গণজমায়েতে অংশ নেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, লেবার পার্টি, এবি পার্টি, জনতার দল, আপ বাংলাদেশ, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, ইসলামী ছাত্রশিবির, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, জুলাই ঐক্য, জাগ্রত জুলাই, জুলাই মঞ্চ, ইনকিলাব মঞ্চের নেতা-কর্মীরা। গণজমায়েতে আরও উপস্থিত হন জুলাই গণ অভ্যুত্থানে আহত যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
শুক্রবার বিকালে শাহবাগ মোড়ে শুরু হওয়া অবরোধ কর্মসূচি চলমান ছিল গতকাল সকালেও। বেলা ৩টায় শুরু হয় পূর্বঘোষিত গণজমায়েত কর্মসূচি। তীব্র দাবদাহে শুরুর দিকে মানুষের উপস্থিতি কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে শাহবাগ মোড়ে এসে অবস্থান নেন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ, শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা সিবগাতুল্লাহসহ বেশ কয়েকজন।
বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠিত হয় সংক্ষিপ্ত সমাবেশ। সমাবেশে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমাদের ঐক্য বিনষ্টের জন্য নানান ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এটা নির্দিষ্ট কোনো দলের নয়, এটা ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের আন্দোলন। বাংলাদেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত-বাংলাদেশপন্থি আর ফ্যাসিবাদপন্থি। যারা আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ চায়, তারা বাংলাদেশপন্থি আর যারা চায় না, তারা ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে গত পরশু রাত থেকে আমি রাস্তায় আছি। যে কোনো সময় অসুস্থ হয়ে যেতে পারি। আমি বলতে চাই, কোনো ষড়যন্ত্রে বা চাপে যদি আমার মুখ থেকে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ানো হয়, আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। পরবর্তী সময়ে আমি যদি কোনো ঘোষণা না-ও দিই, মনে রাখবেন আপনাদের মনজিলে মকসুদ হচ্ছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত আপনারা রাজপথ ছাড়বেন না। হাসনাত আরও বলেন, ২০১৩ সালে এই শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শোনা গিয়েছিল। আমরা এখান থেকে ফ্যাসিবাদের পতনধ্বনির শেষ পেরেকটা মারব। আমাদের মতপথ আলাদা হতে পারে, কিন্তু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে আমরা ঐক্যবদ্ধ। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে, ড. ইউনূস আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছেড়ে যাব না। আওয়ামী লীগ হলো ফেরাউনের বাহিনী। এ ফেরাউনের বাহিনী বাংলাদেশে থাকতে পারে না। কিছু রাজনৈতিক নেতার মনে আওয়ামী লীগের জন্য প্রেম জেগেছে। তারা দাদাবাবুদের দেশে চলে যাক। তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূসকে বলতে চাই-নয়টি মাস অতিক্রান্ত হলেও আওয়ামী লীগের বিচারের কোনো অগ্রগতি নেই। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। যদি না হয়, বাংলাদেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, রাতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক থেকে যেন সব ফয়সালা হয়ে যায়। আমাদের যেন আর পথে নামতে না হয়। এরপর যদি আমাদের মাঠে নামতে হয়, আমরা কিন্তু নতুন সরকারের জন্য নামব। আপনাদের পেছন থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেব। আমাদের কথা পরিষ্কার, আজ রাতে আমরা ফয়সালা চাই।
স্লোগানে স্লোগানে দিনভর মুখরিত শাহবাগ : ‘আওয়ামী লীগের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘আওয়ামী লীগের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না’, ‘লীগ ধরো, জেলে ভরো’, ‘ব্যান ব্যান, আওয়ামী লীগ’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র-জনতা জেগেছে’, ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’, ‘ক্ষমতা না জনতা, জনতা জনতা’, ‘গোলামি না আজাদি, আজাদি আজাদি’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘দফা এক দাবি এক, লীগ নট কাম ব্যাক’, ‘আওয়ামী লীগের নিবন্ধন, বাতিল করো, করতে হবে’, ‘এক দুই তিন চার, চুপ্পু তুই গদি ছাড়’, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’ আন্দোলনকারীরা দিনভর এসব স্লোগান দেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে সূত্রপাত ঘটে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের এ আন্দোলনের। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম সমন্বয়ক, এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ এ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। আন্দোলন কেন্দ্র করে শুক্রবার রাতে ফেসবুক পোস্টে তিন দফা দাবি জানান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিন দফা দাবির মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে নিষিদ্ধ করা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে আওয়ামী লীগের দলগত বিচারের বিধান যুক্ত করা এবং জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করা।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের ঘোষণা আসার পর গত রাতে সারা দেশে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণের খবর পাওয়া গেছে।