চার মাস চিকিৎসা শেষে আজ লন্ডন থেকে দেশে ফিরছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। কাতারের আমিরের দেওয়া বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় ফিরছেন তিনি। গতকাল লন্ডন সময় বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে হিথরো বিমানবন্দর রানওয়ে থেকে তাঁকে বহনকারী উড়োজাহাজটি আকাশে ওড়ে। এর আগে বিমানবন্দরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তাঁর মমতাময়ী মাকে বিদায় জানান। এ সময় সেখানে আবেগঘন পরিবেশ বিরাজ করে। বিএনপি চেয়ারপারসনকে বহনকারী উড়োজাহাজটি দোহার হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে স্থানীয় সময় (রাত) ১টা ২৫ মিনিটে। যাত্রাবিরতি শেষে সেখান থেকে রাত ২টা ৩০ মিনিটে রওনা হয়ে উড়োজাহাজটি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবে বাংলাদেশ সময় আজ সকাল সাড়ে ১০টায়। খালেদা জিয়ার আগমন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রটোকলসহ নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চেয়ারপারসনের সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ) সদস্যরাও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন। বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবে ঢাকা মহানগর পুলিশ। জনসাধারণকে এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গুলশান/বনানী থেকে উত্তরা পর্যন্ত সড়ক যথাসম্ভব এড়িয়ে বিকল্প রাস্তায় চলাচলের অনুরোধ করা হয়েছে। ওই সময় বিএনপি কর্মীদের রাস্তায় না থেকে ফুটপাতে অবস্থান করতে অনুরোধ করা হয়েছে। সুশৃঙ্খল ও সারিবদ্ধভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তাদের প্রিয় নেত্রীকে স্বাগত জানানোর কথা বলা হয়েছে। রাস্তায় যেন যানজট এবং জনসাধারণের ভোগান্তি না হয়, সেজন্য দল বা অঙ্গসংগঠনের কে কোথায় দাঁড়াবেন তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দলীয় প্রধানের দেশে ফেরা উপলক্ষে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে প্রস্তুত করা হয়েছে গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফিরছেন তাঁর দুই পুত্রবধূ তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি। ডা. জুবাইদা ফিরছেন দীর্ঘ ১৭ বছর পর। তাঁর থাকার জন্য ধানমন্ডিতে বাবার বাড়ি ‘মাহবুব ভবন’ প্রস্তুত করা হয়েছে। বেগম জিয়ার বিমানে তাঁর দুই পুত্রবধূ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে যাওয়া তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রফেসর ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, প্রফেসর ডা. শাহাবউদ্দিন তালুকদারসহ দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ব্যক্তিগত সহকারী, যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ১৫ জন আসছেন বাংলাদেশে। গতকাল ৫ মে সকাল থেকেই ব্রিটেনের আনাচকানাচে, শত শত মাইল দূরের শহর থেকে নেতা-কর্মীদের ভিড় ছিল হিথরোমুখী। হোয়াইট্যাপেল থেকে হিথরো বিমানবন্দরে হাজার হাজার বিএনপি নেতা-কর্মী সমবেত হন। ট্রেনে এবং প্ল্যাটফর্মে শেতাঙ্গ মানুষজন অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।
বিমানবন্দরে বেগম খালেদা জিয়াকে দলের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির নেতারা তাঁকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানাবেন। বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেট দিয়ে বের হয়ে দুই পুত্রবধূকে নিয়ে গুলশানের বাসা ফিরোজায় যাবেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফিরতি সফরসঙ্গী হিসেবে অন্যদের মধ্যে থাকছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এনামুল হক চৌধুরী, বিএনপি নেতা তাবিথ আউয়াল, লন্ডন বিএনপি নেতা কয়সর এম আহমেদ, বেগম দিলারা মালিক, ড. জাফর ইকবাল, চেয়ারপারসনের এপিএস মাসুদুর রহমান, দুই গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম ও রূপা শিকদার। গুলশানের বাসায় পৌঁছানোর পর ডা. জুবাইদা রহমান তাঁর মাকে দেখতে ধানমন্ডির বাড়িতে যাবেন।
২০১৮ সালে খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। করোনা মহামারির সময় বিগত সরকার তাঁকে বিশেষ শর্তে কারাগার থেকে গুলশানের বাসায় থাকার অনুমতি দেয়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতির আদেশে তিনি মুক্তি পান। এরপর দুর্নীতির যে দুটি মামলায় তিনি কারাবন্দি ছিলেন, সেগুলোর রায় বাতিল করেন আদালত।
চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। লন্ডন ক্লিনিকে টানা ১৮ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়া তাঁর ছেলে তারেক রহমানের বাসায় লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
২০২১ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার্থে বিদেশে ‘অ্যাডভান্স হেলথকেয়ার সেন্টার’-এ নেওয়ার অনুমতির জন্য ফ্যাসিস্ট সরকারের কাছে তাঁর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড এবং জিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে ১৮ বার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বিশেষ করে লিভার সিরোসিস ধরা পড়ার পর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত এই সুপারিশ করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই তা প্রত্যাখ্যানই করা হয়নি, শেখ হাসিনা নিজে এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা তামাশা ও হাসিঠাট্টা করেছেন। তাঁর মৃত্যু কামনা করতেও দেখা গেছে শেখ হাসিনাকে।
নেতা-কর্মীরা কে কোথায় অবস্থান করবেন : বেগম খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা উপলক্ষে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অবস্থান নিয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি বিমানবন্দর থেকে লা মেরিডিয়ান হোটেল, ছাত্রদল লা মেরিডিয়ান হোটেল থেকে খিলক্ষেত, যুবদল খিলক্ষেত থেকে হোটেল র্যাডিসন এবং মহানগর দক্ষিণ বিএনপি হোটেল র্যাডিসন থেকে আর্মি স্টেডিয়াম, স্বেচ্ছাসেবক দল আর্মি স্টেডিয়াম থেকে বনানী কবরস্থান, কৃষক দল বনানী কবরস্থান থেকে কাকলী মোড়, শ্রমিক দল কাকলী মোড় থেকে বনানী শেরাটন হোটেলের সামনে, ওলামা দল, তাঁতী দল, জাসাস, মৎস্যজীবী দল বনানী শেরাটন হোটেল থেকে বনানী কাঁচাবাজার, মুক্তিযোদ্ধা দলসহ সব পেশাজীবী সংগঠন বনানী কাঁচাবাজার থেকে গুলশান-২, মহিলা দল গুলশান-২ গোলচত্বর থেকে গুলশান অ্যাভিনিউ রোড এবং বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতারা গুলশান-২ গোলচত্বর থেকে গুলশান অ্যাভিনিউ রোডে অবস্থান করবেন। রিজভী বলেন, বিমানবন্দর এবং চেয়ারপারসনের বাসভবনে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। সব নেতা-কর্মী দলীয় এবং জাতীয় পতাকা হাতে রাস্তার এক পাশে দাঁড়াবেন। চেয়ারপারসনের গাড়ির সঙ্গে মোটরসাইকেল এবং হাঁটাচলা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।