বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর গুলশান থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলার বাদী নিজেই স্বীকার করেছেন, এজাহারভুক্ত অধিকাংশ আসামিকে তিনি চেনেন না। এজাহারভুক্ত তিনজন ভুক্তভোগী মামলা থেকে তাদের নাম তুলে নিতে বাদীকে অনুরোধ করেন। বাদী তার নেতার সঙ্গে কথা বলে সাত দিনের মধ্যে বিষয়টি ফায়সালা করবেন বলে ভুক্তভোগীদের কথা দেন। সাত দিন পর ভুক্তভোগীরা যোগাযোগ করেন মামলার সেই বাদীর সঙ্গে। বাদীর এবার সাফ জবাব- মামলা থেকে নাম তুলে নেবে, কিন্তু বিনিময়ে দিতে হবে ৬ কোটি টাকা। অন্যথায় মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়া হবে না। জুলাই বিপ্লবের পর মামলা বাণিজ্যের এটি একটি উদাহরণ।
গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশে মামলা বাণিজ্যের একটি ভয়ংকর চক্র গড়ে উঠেছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশজুড়ে এ পর্যন্ত হওয়া ঢালাও মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনা সম্পর্কে আসামিদের সিংহভাগ কিছুই জানেন না। বাদী চেনেন না আসামিকে, আসামিরাও চেনেন না বাদীকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাদী নিজেও ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য দিয়ে দায়ের করা মামলা থেকে আসামিদের নাম কেটে দিতে মামলাবাজ চক্রের সদস্যরা দাবি করছে লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত। দেশজুড়ে বর্তমানে ভয়ংকর এ চক্রটি এভাবেই করছে ‘মামলা বাণিজ্য’। আর ‘মামলা বাণিজ্য’ করতে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, সরকারি কর্মকর্তাসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষকে আসামি করা হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভয়ংকর এ চক্রের সঙ্গে পুলিশেরও একটি অংশ জড়িত রয়েছে। এমনই ঢাকার এক থানার একটি মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে। হয়রানির উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তার করা ওই কর্মকর্তা জামিনের আবেদন করলেই নতুন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এভাবেই একে একে আরও চারটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ওই কর্মকর্তাকে। অথচ তিনি জানেন না তার কী অপরাধ। মামলাগুলোর বাদীও তাকে চেনেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও মামলার এই ভয়ংকর চক্রের তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রহসনমূলক মামলার কারণে প্রকৃত মামলাগুলো তার মেরিট হারাবে এবং প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিচারব্যবস্থার এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ইতোমধ্যে অনেক বাদী নিরপরাধ ব্যক্তিদের মামলা থেকে বাদ দিতে আদালতে হলফনামাও দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, এমন এক পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসে পুলিশ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলার তদন্তে উপযুক্ত প্রমাণ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এজাহারনামীয় আসামিকে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ দেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ৯ এপ্রিল ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদেশে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সংক্রান্তে রুজু করা মামলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এজাহারনামীয় আসামির সংখ্যা অধিক। এসব মামলার এজাহারনামীয় কিংবা তদন্তে প্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তারের নিমিত্তে উপযুক্ত প্রমাণসহ অবশ্যই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গ্রেপ্তার করতে হবে। এতে আরও বলা হয়, উপযুক্ত প্রমাণ এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত বৈষম্যবিরোধী মামলার এজাহারনামীয় কিংবা তদন্তে প্রাপ্ত কোনো আসামি গ্রেপ্তার না করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, চাঁদাবাজি, পূর্বত্রুতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মামলায় টার্গেট করে আসামি করা হচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, মামলায় কাদের আসামি করা হবে, সেক্ষেত্রে বাদীর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিয়ন্ত্রণ ছিল অন্যদের হাতে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীসহ সরকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা দিত পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতারা। এখন দেখা যাচ্ছে, হত্যা মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করা হয়েছে ‘ইচ্ছেমতো’।
এ বিষয়ে অপরাধ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকার পরও জুলাই-আগস্টসহ বিভিন্ন মামলায় জড়ানো হচ্ছে নিরপরাধ ব্যক্তিদের। দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। এটা আইনের মারাত্মক পরিপন্থি। এটা ওই ভুক্তভোগীর মনস্তাত্ত্বিক জগতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এক সময় দেখা যাবে, এসব ভুক্তভোগী প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবেন। এটা সমাজে স্থায়ী নৈরাজ্য এবং অরাজকতার জন্ম দেবে। তিনি আরও বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তার উচিত হবে তদন্তসাপেক্ষে দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব নিরীহ ব্যক্তিদের মামলা থেকে বাদ দেওয়া। একই সঙ্গে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা।