বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হন গাজীপুরের টঙ্গীর কলেজছাত্রী নাফিসা হোসেন মারওয়া। বড় মেয়ে নাফিসাকে ছাড়া এবারই প্রথম ঈদ পালন করবেন তার বাবা-মা। এ ব্যাপারে নাফিসার বাবা আবুল হোসেন বলেন, ‘মেয়ে নাফিসা সব সময় ঈদের সময় নতুন কাপড় চাইত। চিনি, সেমাই, গরুর মাংস, রুটি খেতে পছন্দ করত। তাছাড়া ঈদে সে ঘুরে বেড়াতেও পছন্দ করত। মেয়ের সব চাওয়া পূরণ করার চেষ্টা করেছি।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘এবার আমি সব ছেড়ে নিঃস্ব জীবনযাপন করছি। এখন আমি পরিবারশূন্য। এবারের ঈদ তিনি টঙ্গীর বাসায় একাই করবেন। ঈদে ছোট মেয়ে রাইসার সঙ্গে দেখা করব।’ তিনি আরও বলেন, আমার আদরের বড় মেয়ে ফ্যাশন ডিজাইনার হতে চেয়েছিল। তার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।’ ঈদের প্রাক্কালে আবুল হোসেন বলেন, ‘ঈদে আমি আর কিছুই চাই না, আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।’ নাফিসা হোসেন মারওয়া টঙ্গীর সাহাজ উদ্দিন সরকার স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে গত বছর বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। জিপিএ-৪.২৫ পেয়ে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণও হয়েছিলেন তিনি। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফল প্রকাশের মাত্র এক সপ্তাহ আগে শহীদ হন নাফিসা। তাঁর ছোট বোন সাফা হোসেন রাইসা সাভারে নানির বাসায় থেকে একটি মাদরাসায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। মা কুলসুম বেগম ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্নে ২০২২ সালে পাড়ি জমান কুয়েতে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের টঙ্গী এরশাদনগর ৮ নম্বর ব্লকের একটি ছোট ভাড়া বাসায় ছোট বোন ও চা দোকানি বাবার সঙ্গে থাকতেন নাফিসা। আন্দোলনের প্রথমদিকে মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে নিজেদের মধ্যে আলাপ করে প্রতিদিন রাজপথে নামতেন নাফিসা ও তার সহপাঠীরা। ১৮ জুলাই থেকে তিনি উত্তরায় ছাত্র আন্দোলনে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। বাবা সকালে দোকানে চলে গেলে, কাউকে না জানিয়ে আন্দোলনে যেতেন নাফিসা। প্রতিবেশীদের মাধ্যমে মেয়ের আন্দোলনে যাওয়ার খবর শুনে বাবা আবুল হোসেন রাগারাগি করেন। একপর্যায়ে ২৮ জুলাই বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে নাফিসা ঢাকার ধামরাইয়ের বড় মামার বাসায় যান। সেখান থেকে ৩০ জুলাই সাভারে ছোট মামার বাসায় ওঠেন। কিন্তু সেখান থেকেও বান্ধবীদের সঙ্গে প্রতিদিন আন্দোলনে অংশ নেন। ৫ আগস্ট সকালে মামাদের বাধা উপেক্ষা করে সাভারে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লং মার্চে যোগ দেন। দুপুর ২টার দিকে সাভার মডেল মসজিদসংলগ্ন রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন নাফিসা। অন্য শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকলে কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে বেলা ৩টা ৩২ মিনিটের দিকে তিনি মারা যান। এখনো প্রায় প্রতিদিন কবরে গিয়ে আদরের মেয়ে নাফিসাকে খুঁজে ফেরেন আবুল হোসেন। মেয়ের কথা মনে হলেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। তিনি এখন আর চায়ের দোকান করেন না। যখন যে কাজ পান তাই করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বাসায় একা একা মেয়ের বই ও অন্যান্য জিনিস নাড়াচাড়া ও স্মৃতিচারণ করে সময় কাটান।