আমি যখন অষ্টম-নবম শ্রেণির ছাত্র, তখন গণ অভ্যুত্থান হয়। আমি রাজশাহী থেকে গোদাগাড়ী যাই। সেখান থেকে রাজশাহী কলেজের শিক্ষক, দুলু ভাইসহ আমরা ভারতে চলে যাই। ভারতের লালগোলা ক্যাম্পে যোগদান করি এবং উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য চাকুলা ক্যান্টনমেন্টে যাই। আমার সঙ্গে ছিল তইবুর রহমান, শফিকুর রহমান রাজা, মাসুদসহ অনেকে। তারপর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি এবং সেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে আবার লালগোলা ক্যাম্পে ফিরে আসি। যুদ্ধ হচ্ছে না বলে পাকিস্তান প্রোপাগান্ডা ছড়ালে জাতিসংঘের একটা টিম দেখতে আসে। তখন মেজর গিয়াসসহ আমরা পাঁচজন করে টিম যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশে আসি। তখন সোনাদীঘি পানির ট্যাংক, কোর্ট এলাকা ও বিদ্যুৎ অফিসে আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখানে সফলভাবে অপারেশন শেষ করে আবার ভারতে ফিরে যাই। এটা ছিল প্রাথমিক অপারেশন। এভাবে বিভিন্ন সময় মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে সফল অপারেশন চালিয়েছি। এর মধ্যে ছিল অভয়া ব্রিজ, সাকওয়া ক্যাম্পসহ তানোর অঞ্চল। এখানে আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপারেশন হলো সাকওয়া ক্যাম্প। এখানে এসে চারদিক থেকে আমরা পাক বাহিনী ঘিরে ফেলি। তখন তারা আত্মসমর্পণ করলে পাশ থেকে একটি ফুটফুটে মেয়ে এসে জানায়, এ ক্যাম্পে তার বাবাকে এনে হত্যা করা হয়েছে। তখন কবর খুঁড়ে দেখা যায় তরতাজা একটি নিথর দেহ সেখানে পুঁতে রাখা হয়েছে। এটা দেখে আমি ব্যাপক উত্তেজিত হই এবং কোদাল দিয়ে পাক হানাদারের মাথায় আঘাত করে তাকেও সেভাবে ওখানেই সমাধি দিই। ওখান থেকে রাজশাহীতে ফিরে আসি। তারপর সিটি কলেজ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জোহা হলে যাই এবং সেখানে অস্ত্র জমা দিয়ে আমরা নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যাই।
মুক্তিযুদ্ধে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা অভয়া ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া অভিযান। সেদিন আমি একবুক পানিতে নেমে যুদ্ধ করেছি। মাঝপথে আমার অস্ত্র হারিয়ে যায়। পাক বাহিনীর ব্যাপক গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। সেখানে আমাদের দুজন সহযোদ্ধা শহীদ হন। পানির মধ্যে মৃদুভাবে আমার পায়ে একটা গুলি লাগে। তবে আহত হইনি। সফলভাবে সে অভিযান শেষ করি। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এ ছাড়া ঊনসত্তরে ড. শামসুজ্জোহা ও নুরুল হুদাকে যখন পাক হানাদাররা হত্যা করে তখন আমি ছাত্র এবং আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি। ফলে এগুলো আমাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছে। আমার চাওয়া ছিল বৈষম্যহীন একটি সমাজব্যবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা সিটি কলেজে অবস্থান নিই। দেশের চারদিকে লুটতরাজ। কোনো আইনের শাসন ছিল না। ১৮ ডিসেম্বর আমরা রাজশাহী ফিরি। এসে শুনি তখনো উপশহরে যুদ্ধ চলছে। পাক বাহিনী ক্যাম্প ছাড়েনি। আমরা সেখানে গেলাম এবং ব্যাপক ফায়ারের মাধ্যমে তাদের হটিয়ে দিই। মূলত ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী স্বাধীন হয়েছে।