সন্ধ্যার আলো তখন একটু একটু করে গাঢ় হচ্ছে। ঢাকার কোনো এক ছাদে কেউ হয়তো অ্যাকুয়াস্টিক গিটারে তুলছেন, ‘চলো না ঘুরে আসি, অজানাতে, যেখানে নদী এসে থেমে গেছে...’ এই চেনা সুরটা শুনলেই কেমন একটা কুয়াশামাখা নস্টালজিয়ায় ভেসে যেতে ইচ্ছে করে, না? এ গান শুধু গান নয়, একটা সময়, একটা অনুভব, একটা মানুষ: লাকী আখন্দ। ছোটবেলা থেকেই তাঁর হাতে যেন সুর খেলা করত। মাত্র ১৪ বছর বয়সে পাকিস্তানের এইচএমভির সুরকার, আর ১৬ বছর বয়সে ভারতের এইচএমভিতে সংগীত পরিচালক! ভাবা যায়? যে বয়সে স্কুল ডায়েরিতে টুকটাক আঁচড় কাটত প্রজন্মরা, তিনি তখন স্টুডিওর মাইক্রোফোনে গানের রূপরেখা দিচ্ছেন। লাকীর সংগীত জীবনের সবচেয়ে মিষ্টি গল্পগুলোর একটি লুকিয়ে আছে তাঁর বন্ধুর লেখা- ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা...’ গানে। গল্পটি অনেকটা এ রকম- নওগাঁর জমিদারবাড়ি ঘুরতে গেছেন লাকী আর বন্ধু গীতিকার এস এম হেদায়েত। একদিন সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে দেখলেন, বেদেনীরা রঙিন শাড়ি পরে হেঁটে যাচ্ছে, যেন আকাশে রং খেলা করছে। লাকী বললেন, ‘দোস্ত, কিছু লেখ! এমন দৃশ্য তো রোজ দেখা যায় না!’
হেদায়েত লিখলেন, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে...’ তবে এরপর আর কিছুই বের হচ্ছিল না। অনেক কষ্টে, কাটাছেঁড়া করে শেষে এলো, ‘চলো না ঘুরে আসি, অজানাতে...যেখানে নদী এসে থেমে গেছে।’ একটা গান, একটা মুহূর্ত, আর একটা অসম্ভব প্রতিভাবান বন্ধুত্ব- এই তিনে মিলে তৈরি হলো এক কালজয়ী সৃষ্টি।
লাকী আখন্দ শুধু একজন সুরকার ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক সাউন্ডস্কেপ নির্মাতা। তাঁর সুরে ছিল আবেগ, অভিমান, প্রেম, বিচ্ছেদ, আর কোথাও যেন একটা ছুঁঁয়ে যাওয়া নীরবতা। আরেক গল্প- ‘ভালোবেসে চলে যেও না’। গেয়েছিলেন জেমস। এই গানটি শুনলে অনেকেই ভাবেন এটা স্রেফ একটি প্রেমের গান। আসলে? এক অভিমানী ফিরে আসার ডাক। যেন কারও কাছে একটি শেষ চিঠি। এক সময় ছোট ভাই হ্যাপী আখন্দকে হারিয়ে গান থেকে সরে গিয়েছিলেন। এক দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে ‘পরিচয় কবে হবে’ অ্যালবামে ফিরলেন, যেন অভিমান ভেঙে সুরের কাছেই ফিরলেন। এরপর এলো সেই ঐতিহাসিক মিক্সড অ্যালবাম ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’। যেখানে একসঙ্গে কাজ করলেন আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, কুমার বিশ্বজিৎ, সামিনা চৌধুরী- এক অদ্ভুত প্রজন্ম মেলবন্ধনের গল্প। ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল, পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় নিঃশব্দে চলে গেলেন লাকী আখন্দ। তাঁর বিদায়ের সময় কি আশপাশে বাজছিল কোনো গিটার? ভেসে আসছিল কি- ‘যেখানে সীমান্ত তোমার...।’ না কি কেউ ফিসফিস করে গেয়ে উঠেছিল, ‘ভালোবেসে চলে যেও না’- জানার সুযোগ নেই। শুধু এটুকু জানা যায়, লাকী আখন্দ ছিলেন সেই বিরল শিল্পী, যাঁর সুরের মধ্যে আবিষ্কার করা যায় ভালোবাসা, অনুভব আর এক অমোঘ নৈঃশব্দ্য।
তিনি আজ নেই, কিন্তু তাঁর গানের সন্ধ্যা, তাঁর সুরের নদী- সে তো এখনো বইছে।