নদী প্রকৃতির প্রাণ। দেশের প্রতিটি নদীর গুরুত্ব অত্যধিক। নদী মানুষের নিত্যজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। নদী বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে, দেশ বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে। নদীকে গলা টিপে হত্যা করার সব আয়োজন সম্পন্ন করে দেশ বাঁচানোর স্বপ্ন কেবলই অলীক। তা ছাড়া বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। সময়ের বাস্তবতায় এখন দেশের সেই অভিধা কতটুকু অবশিষ্ট-অমলিন আছে, তা নিয়ে চিন্তা করার সময় হয়েছে। অন্যদিকে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্ণফুলী নদী শুধু একটি নাম নয়। এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেশের জাতীয় অর্থনীতি। কারণ কর্ণফুলী নদীর কোলেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। এই বন্দরই দেশের অর্থনীতির ফুসফুস। ফলে আর দশটি নদীর সঙ্গে মিলিয়ে এই নদীকে মূল্যায়ন বা নদীর ব্যবস্থাপনা করলে তার চরম খেসারত দিতে হবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কর্ণফুলী নদী বেহাল হওয়া মানে বন্দরে এর প্রভাব পড়া। নদীটি ভরাট-দখল হওয়া মানে বন্দরের বুকে ধাক্কা দেওয়া। এই সহজসরল ও সত্য কথাটা কে বোঝে না। এখন এমন প্রশ্নও সামনে আসছে কর্ণফুলী নদীকে বাঁচানো যাবে তো?
দুই. বর্তমানে কর্ণফুলী নদী কেমন আছে- তার কিছু তথ্য দেওয়া যাক। চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের ২০২০ সালের এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শাহ আমানত সেতু এলাকায় জোয়ারের সময় নদীটির প্রস্থ ৫১০ মিটার ও ভাটার সময় ৪১০ মিটার, যা আগে ছিল ৮৮৬ মিটার। রাজাখালী খালের মুখে নদীর প্রশস্ততা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফিরিঙ্গি বাজার পয়েন্টে নদীর প্রস্থ ছিল ৯০৪ মিটার, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গাইড ওয়াল নির্মাণের পর সেখানে নদী আছে ৭৫০ মিটার।’ কর্ণফুলীর দুই তীরে বাংলাবাজার ঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত মাত্র তিন কিলোমিটার এলাকায় গড়ে উঠেছে ১৪০টি জেটি ও ঘাট। নদীর গুরুত্বপূর্ণ এই অংশে বিপুল স্থাপনার কারণে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে কর্ণফুলী চ্যানেল। এর প্রভাব পড়ে বন্দরে। বাড়ছে নৌ-দুর্ঘটনা। অন্যদিকে নগরের সব ধরনের বর্জ্য ৩৬টি খাল হয়ে সরাসরি পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। বর্তমানে নগরের ৩৬টি খাল দিয়ে দিনে প্রায় ৫ হাজার টন পয়োবর্জ্য ও গৃহস্থালির বর্জ্য পড়ছে কর্ণফুলীতে। সঙ্গে আছে শিল্প ও চিকিৎসাবর্জ্য। আছে নদীতে চলাচলকারী নৌযানের পোড়া তেল। ফলে দূষণে চরম দুরবস্থা নদীটির। প্রতিনিয়তই চাক্তাই ও রাজাখালী খাল দিয়ে কালো রঙের তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত পানি নামছে কর্ণফুলীতে। বর্জ্যরে বিষে নীল খালের পানি গন্ধ হয়ে যায়। তা ছাড়া ইউনিভার্সিটি অব হংকং, আরএমআইটি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কর্ণফুলীতে কেবল সার কারখানাগুলোই প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ দূষিত পানি, ৩৫ মেট্রিক টন চায়না মাটি, ৪ মেট্রিক টন সেলুলোজ এবং সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড ফেলে। বিষাক্ত বর্জ্য নিঃসরণকারী শিল্পের মধ্যে আছে ২৬টি টেক্সটাইল, একটি তেল শোধনাগার, একটি সার কারখানা, দুটি রাসায়নিক শিল্প, পাঁচটি মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট, পাঁচটি কীটনাশক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের ১৭টি শিল্প জোনের প্রায় ৩০০ শিল্পপ্রতিষ্ঠানও দূষণ সৃষ্টি করছে। তা ছাড়া কর্ণফুলী নদীর পানিতে প্রতি লিটারে জৈবরাসায়নিক অক্সিজেনের (বিওডি) স্বাভাবিক মাত্রা ৬ মিলিগ্রামের নিচে থাকার কথা। কিন্তু প্রতিনিয়তই এই বিওডি পাওয়া যায় ১২ থেকে ২৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ কর্ণফুলী নদীর মাছের ওপর গবেষণা পরিচালনা করে। এতে বলা হয়, ‘কর্ণফুলীতে স্বাদুপানির ৬৬ প্রজাতির মধ্যে ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্ত, লবণপানির ৫৯ প্রজাতির মধ্যে ১০ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে ডলফিনসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য। সংগৃহীত পানির নমুনায় মানবদেহে ক্যানসারের ঝুঁকি তৈরি করে এমন উপাদানও পাওয়া যায়।’ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল কর্ণফুলী পরিদর্শনের পর দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন সংস্থা নিয়মের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে নদীতীর দখল করে কাঠামো নির্মাণ করছে। যা নদীর প্রবাহ সংকুচিত করছে। ফলে নদী বন্যার সময় অতিরিক্ত পানি ধরে রাখতে পারবে না। তা ছাড়া নদীর ধারণক্ষমতা দ্রুত কমে যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীটি ঘূর্ণিঝড়, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যর্থ হবে। অথচ আইনে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ এবং প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ অনুসারে, নদীর তীর ইজারা দেওয়া যাবে না, কোনো সংস্থা নদী দখল বা ভরাট করে কাঠামো তৈরি করতে পারবে না।’ কিন্তু এই আইন লঙ্ঘন করেই কর্ণফুলী নদীতে বিভিন্ন সময় তীর ইজারা দেওয়া হয়।’
তিন. নগরের খালগুলোতে সরাসরি ফেলা হয় গৃহস্থালি, চিকিৎসা ও শিল্পবর্জ্য। এসব গিয়ে পড়ে কর্ণফুলীতে। দূষণ হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। দখল হচ্ছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। নদীর তীর দখল করে গড়ে উঠেছে শত শত আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা। স্থাপনাগুলোর বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে নদীতে। এত সব বিষে নীল হয়ে কার্যত মৃত্যুর দিকেই এগোচ্ছে কর্ণফুলী। তবে কি এভাবেই কর্ণফুলীকে মেরে ফেলা হবে? এ নদী মরলে কি বন্দর বাঁচবে? বন্দর না বাঁচলে কী হবে দেশের জাতীয় অর্থনীতির। এসব নিয়ে ভাবতে হবে। দয়া করে কর্ণফুলী নদীর ওপর সব শকুনি দৃষ্টি রুখে দিন। বাঁচান কর্ণফুলী। বাঁচুক বন্দর। বাঁচবে দেশ, দেশের অর্থনীতি।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী