বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৪৭ ও ১৯৭১ দুটি বছরই মাইলফলক। কিন্তু তাদের প্রেক্ষাপট, প্রেরণা ও ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাজনের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল পাকিস্তান, যেখানে ধর্ম ছিল রাষ্ট্র গঠনের প্রধান উপাদান। অন্যদিকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল জাতিসত্তা ও মুক্তির চেতনার ভিত্তিতে। এই দুই বছরের মধ্যবর্তী চব্বিশ বছরে বাঙালি জাতি উপলব্ধি করেছিল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ধারণা কতটা ভ্রান্ত এবং মানবিক মর্যাদা, ন্যায় ও সমতার প্রশ্নে তা কতটা সীমাবদ্ধ। এই প্রেক্ষাপটেই ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আবারও প্রশ্ন উঠছে জামায়াতে ইসলামী কি এবার নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পুনর্নির্ধারণ করবে, নাকি ইতিহাসের ভুল পুনরাবৃত্তি ঘটাবে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা সব সময়ই বিতর্কিত। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তাদের অবস্থান, স্বাধীন বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশের পর রাজনৈতিক আচরণ এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা সবকিছু মিলিয়ে দলটি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে ইসলামি আদর্শের নামে রাজনীতি করলেও বাংলাদেশের জনমনে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কখনোই স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর প্রধান কারণ তাদের ঐতিহাসিক দায় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার বিরোধিতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ততার অভিযোগ। যদিও পরবর্তী প্রজন্মের অনেক নেতা এই অতীত থেকে সরে আসার চেষ্টা করেছেন, তবু সংগঠন হিসেবে জামায়াত কখনোই স্পষ্টভাবে সেই অতীতের ভুল স্বীকার বা পর্যালোচনা করেনি। ২০২৬ সালের নির্বাচনে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখানেই নিজেদের রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করা।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা ১৯৪৭ বা ১৯৭১ সালের মতো নয়। আজকের বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, যার নাগরিকরা ধর্মের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ন্যায়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের দাবিতে বেশি সচেতন। মানুষ এখন আর ধর্মীয় আবেগে রাজনীতি নির্ধারণ করে না; বরং তারা দেখে কে তাদের জীবনের উন্নতি ঘটাতে পারবে, কে দুর্নীতি রোধ করবে, কে নাগরিক অধিকার রক্ষা করবে। এই প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামীর কাছে প্রশ্ন হলো তারা কি আদৌ নিজেদের ধর্মভিত্তিক পরিচয় ছাপিয়ে একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে?
যদি তারা ২০২৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে চায়, তবে প্রথমেই প্রয়োজন একটি স্পষ্ট মতাদর্শিক সংস্কার। ইসলামি রাজনীতির নামে কেবল প্রতীকী ধর্মীয় ভাষণ আর আবেগনির্ভর প্রচার দিয়ে জনগণকে আকৃষ্ট করা যাবে না। বাংলাদেশের সমাজ আজ বহুমাত্রিক, এখানে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। এই প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ, বিশ্বরাজনীতি বোঝে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে সংবেদনশীল। তারা দেখতে চায় এমন একটি রাজনৈতিক দল, যারা ধর্মের মূল্যবোধকে মানবতার আলোকে অনুবাদ করতে পারে, যারা ইসলামি নীতিকে আধুনিক সমাজকল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম।
জামায়াতের জন্য এই পরিবর্তন সহজ নয়। কারণ তাদের সংগঠনের কাঠামো বহু বছর ধরে একটি কঠোর আদর্শিক গণ্ডির মধ্যে পরিচালিত হয়েছে, যেখানে ভিন্নমত বা অভ্যন্তরীণ সমালোচনার খুব বেশি সুযোগ ছিল না। ফলে নতুন প্রজন্মের নেতা তৈরি হলেও তারা পুরোনো চিন্তাধারার বাইরে যেতে পারেনি। ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে যদি জামায়াত সত্যিকার অর্থে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে চায়, তাহলে তাদের নেতৃত্ব কাঠামো, ভাষা, ও রাজনৈতিক কৌশল সবকিছুতেই পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রথমত দলকে অবশ্যই ১৯৭১ সালের অবস্থান নিয়ে একটি পরিষ্কার বক্তব্য দিতে হবে। অনেকেই মনে করেন, এই প্রশ্নে জামায়াত যদি একবার সাহসিকতার সঙ্গে আত্মসমালোচনা করত, তাহলে তাদের প্রতি জনমানুষের ক্ষোভ অনেকটাই প্রশমিত হতে পারত। কিন্তু এখনো তারা সেই রাজনৈতিক সাহস দেখাতে পারেনি। স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস বাংলাদেশের জাতীয় আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এই সত্যকে অস্বীকার করা মানে জনগণের চেতনার সঙ্গে সংঘাত তৈরি করা।
দ্বিতীয়ত জামায়াতকে বুঝতে হবে বাংলাদেশে ইসলামপন্থি রাজনীতি একধরনের পুনর্গঠন পর্যায়ে রয়েছে। হেফাজতে ইসলাম, বিভিন্ন ছোট ইসলামি দল এবং ধর্মভিত্তিক সিভিল সোসাইটির উত্থান প্রমাণ করে যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক চিন্তা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি, তবে এর ধরন পরিবর্তিত হয়েছে। এখন ইসলামকে রাজনীতির হাতিয়ার নয়, বরং নৈতিকতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুপ্রেরণা হিসেবে উপস্থাপন করাই যুগোপযোগী। জামায়াত যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারে, তাহলে তারা হয়তো নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাবে।
তৃতীয়ত জামায়াতের সামনে একটি বাস্তব রাজনৈতিক সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের একটি আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। বিএনপির সামনেও রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ।
তবে এই সুযোগ গ্রহণের আগে জামায়াতকে নিজেদের ইতিহাসের দায় মুছে ফেলার পথ তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার সমীকরণ বদলাতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের বিচার থেকে কেউ পালাতে পারে না। আজকের তরুণ ভোটাররা একাত্তরের প্রজন্ম নয়, কিন্তু তারা ইতিহাস জানে এবং তারা অতীতের অন্যায় ভুলে যায়নি। তাই জামায়াত যদি সত্যিকার অর্থে জনমুখী রাজনীতি করতে চায়, তবে তাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত একটি নতুন রাজনৈতিক নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা।
জামায়াতে ইসলামীর আদর্শিক মূলে রয়েছে ‘ইসলামি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা’র ধারণা। কিন্তু এই ধারণাকে যদি তারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিকভাবে উপস্থাপন করে, তাহলে তা কার্যকর রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি করতে পারবে না। ইসলাম কখনোই অন্যায়, নিপীড়ন বা স্বৈরাচারকে সমর্থন করে না এই মৌলিক সত্যকে কেন্দ্র করে জামায়াত যদি নিজেদের রাজনৈতিক তত্ত্ব নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে, তবে তারা নতুন প্রজন্মের কাছে প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
একই সঙ্গে দলটির প্রয়োজন নারী ও সংখ্যালঘু প্রশ্নে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশের সমাজে নারীর ভূমিকা এখন অর্থনীতি ও প্রশাসন উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জামায়াতের পূর্ববর্তী অবস্থান নারী নেতৃত্ব ও নারী অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ছিল রক্ষণশীল ও সীমাবদ্ধ। এই মনোভাব যদি অপরিবর্তিত থাকে, তবে তারা সমাজের অর্ধেক জনগণকে নিজেদের থেকে দূরে রাখবে। একইভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতি সহনশীলতা, নাগরিক অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট নীতি থাকা প্রয়োজন।
অন্যদিকে রাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকেও জামায়াতের উচিত বাস্তববাদী হওয়া। বাংলাদেশে রাজনীতি এখন আর শুধু আদর্শের লড়াই নয়, বরং সাংগঠনিক দক্ষতা, গণসংযোগ ও গণমাধ্যমব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। জামায়াতের সংগঠনমূলক শক্তি অতীতে ছিল তাদের প্রধান সম্পদ, কিন্তু দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ও সীমাবদ্ধ থাকার কারণে সেই শক্তি দুর্বল হয়েছে। তাই তাদের নতুন করে সাংগঠনিক পুনর্গঠন করতে হবে বিশেষ করে তরুণদের আকৃষ্ট করার মাধ্যমে।
২০২৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মাঠ ইতিমধ্যে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। জামায়াতের আমির ১৯৪৭ সালের পর দল কোনো অপরাধ করলে ক্ষমা চেয়েছেন কিন্তু একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। যা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে সমালোচনা। এই প্রেক্ষাপটে জামায়াত যদি একাত্তরের অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিজেদের নতুনভাবে উপস্থাপন করতে পারে একটি দায়িত্বশীল, নৈতিক ও সংস্কারবাদী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাহলে তারা হয়তো জন আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবে। তবে সেটি হবে না ধর্মীয় আবেগের ওপর ভিত্তি করে, বরং বাস্তববাদী রাজনৈতিক কর্মসূচি, সামাজিক ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার ও অতীতের আত্মসমালোচনার সাহসের মাধ্যমে।
১৯৪৭ সালে ধর্মের নামে রাজনীতি মানুষকে বিভক্ত করেছিল, আর ১৯৭১ সালে মানবমুক্তির সংগ্রাম মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। আজ ২০২৬-এর প্রাক্কালে বাংলাদেশ সেই ঐক্যের চেতনাকেই ধরে রাখতে চায়। জামায়াতে ইসলামীর সামনে তাই দুটি পথ খোলা একটি পুরোনো পথ, যেখানে তারা ইতিহাসের ভারে নত হয়ে প্রান্তিক হয়ে পড়বে; আরেকটি নতুন পথ, যেখানে আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে তারা সত্যিকার অর্থে জনগণের আস্থা পুনর্নির্মাণ করতে পারবে। যে পথ তারা বেছে নেবে, সেটিই নির্ধারণ করবে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নয়, এখন সময় আত্মসমালোচনা ও পুনর্জাগরণের। ২০২৬ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী যদি সত্যিই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারে স্বাধীনতার চেতনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ইসলামি ন্যায়নীতির সংমিশ্রণে তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে। আর যদি তারা সেই সাহস না দেখায়, তবে ইতিহাস আবারও প্রমাণ করবে যে দল নিজ অতীতের মুখোমুখি হতে পারে না, সে ভবিষ্যতের দাবিও রাখতে পারে না।
লেখক : সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংকিং আর্থিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ