ফ্যাসিস্ট ও বৈষম্যমুক্ত নতুন বন্দোবস্তের জন্য নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। শান্তির জন্য দেশবাসী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। সবার প্রত্যাশা ছিল ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি ফিরবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ নিরাপদ থাকবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে-এ ধরনের ইতিবাচক প্রত্যাশায় ছিল সর্বস্তরের মানুষ। কিন্তু এক বছরের বেশি সময়ে দেশবাসীর বুকের ওপর পাথরের ভার আরও ভারী হচ্ছে। অতীত প্রত্যাখ্যান করে নতুনের তিক্ত স্বাদে সবার মুখ গোমড়া। কষ্ট কমল না বাড়ল, তা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। দম বন্ধ হওয়া অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্ত হতে একটি নির্বাচনের অপেক্ষা সবার। সরকার বলছে নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে। সরকারের প্রিয়ভাজনরা বলছেন তাদের শর্ত পূরণ না হলে নির্বাচন হবে না। নির্বাচন কমিশন আস্তে আস্তে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার পরও মনে হচ্ছে রাজনীতি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। নতুন বন্দোবস্তের নামে নতুন করে ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠছে পর্দার আড়ালের খেলোয়াড়রা। সে খেলার যারা ঘুঁটি, তারা রক্তাক্ত হচ্ছে। নিজের শরীরের রক্ত ঝরিয়ে নষ্ট খেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে। দেশ, দেশের মানুষ, দেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধির চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে বিপজ্জনক নষ্ট রাজনীতির লক্ষণগুলো দিনদিন স্পষ্ট হচ্ছে। আগামী দিনে কে ক্ষমতায় আসবে, সে সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর ন্যস্ত না করে ফলাফল নির্বাচনের আগেই নির্ধারণ করার জন্য শুরু হয়েছে অপতৎপরতা। জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। চট্টগ্রামের এ পরিস্থিতি কি নিছক ছাত্র বনাম গ্রামবাসী, নাকি অন্য কিছু? গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা দুর্ঘটনা, নাকি নেপথ্যে আরও কিছু? নাকি নির্বাচন বানচালের কৌশল, তা নিয়ে এখন চলছে নানান পোস্টমর্টেম।
প্রধান উপদেষ্টা ৩১ আগস্ট রবিবার বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে তিনি স্পষ্ট করে তিন দলকেই বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতেই হবে নির্বাচন। বিকল্প কিছু ভাবা বিপজ্জনক। বৈঠক শেষে বিএনপি বলেছে, রোডম্যাপ অনুযায়ী ভোটের আশ্বাস পেয়েছি। জামায়াত বলেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পর নির্বাচন। এনসিপি বলেছে, আগে দিতে হবে গণপরিষদ নির্বাচন। এদিকে দেশের ভিতরে আত্মগোপনে ও বিদেশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রচার করছেন-নির্বাচন হবে ২০২৭ সালে। অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এ তথ্য তাঁরা বিভিন্ন মহলে প্রচার করছেন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে-আগামী ফেব্রুয়ারিতে যাঁরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাচ্ছেন না, অথবা নির্বাচন আটকে দেওয়ার জন্য নানান শর্ত দিচ্ছেন, তাঁদের অবস্থান কোন পক্ষে? পুরোনো বন্দোবস্ত বাদ দিয়ে আমরা নতুন বন্দোবস্তের জন্য প্রতিদিন যুদ্ধ করছি। রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন, ভাঙচুর, কথায় কথায় মব ফ্যাসিজম, চাঁদাবাজি, দখল, ফ্যাসিস্ট তকমা লাগানোসহ আরও কত কিছু যে হচ্ছে, তা শুধু ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারছেন। কোথাও কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আইন আছে কাগজকলমে, কিন্তু আইনের শাসন নেই। কেউ কাউকে মানছে না। সব ক্ষেত্রে বেয়াদবি, অসভ্য আচরণ, অশ্রাব্য গালাগাল আর মিথ্যাচারে ভেসে যাচ্ছে দেশ। সরকারের উপদেষ্টারা অনেকটা কাঠের পুতুল। অনেকে চুপচাপ। কেউ কেউ টিকে আছেন শুধু চাপাবাজির জোরে। কেউ কেউ ধান্দা, চান্দা আর কমিশন বাণিজ্যে ইতোমধ্যে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। আমলারা দেখছেন আর ভাবছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ইতোমধ্যে অনুধাবন করতে পারছেন, ২০২৪-এর ৮ আগস্টে তাঁর পায়ের নিচে মাটি যতটা শক্ত ছিল, ২০২৫-এর সেপ্টেম্বরে তা অনেক বেশি নরম ও পিচ্ছিল হয়ে গেছে। এমন এক পরিস্থিতিতে সরকারের সম্মানজনক বিদায় ও দেশের মধ্যে সকল পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের বিকল্প নেই।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে বিকল্প কিছু ভাবা বিপজ্জনক। বিপদের তাপ কেমন হতে পারে তা সরকার বুঝতে পারছে, কিন্তু কিছু রাজনৈতিক দল বুঝতে পারছে না। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হচ্ছেন। সম্প্রতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা, জাতীয় পার্টির অফিসে আগুনের ঘটনা সম্পর্কে রাজনীতিসচেতন মানুষের মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছে। এটা শুধুই রাজনৈতিক নেতা-কর্মী বনাম সেনাবাহিনী-পুলিশ সদস্যের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, মারামারি, নাকি অন্য কিছু? কেউ বলছেন নির্বাচন করার মতো পরিবেশ নেই- এমন অভিযোগ সামনে আনার জন্য এটা একটা পরিকল্পিত ঘটনা। যারা নির্বাচন চাচ্ছেন না, তারা নুরকে সামনে দিয়ে টেস্ট কেস করেছেন। কেউ বলছেন সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার এটা একটা অপকৌশল। আবার কেউ বলছেন ঘটনাটি জাতীয় পার্টির পক্ষ হয়েই ঘটানো হয়েছে। কারণ জাতীয় পার্টি এখন নিষিদ্ধ হওয়ার পথে। সেই সঙ্গে নতুন গ্রুপিং শুরু হয়েছে। সে কারণে কোনো ঘটনা ঘটিয়ে দলটি নিষিদ্ধ হলে সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় পার্টি সাতবার ভাঙে। লাঙ্গল দাবিদার জাতীয় পার্টি এখন চারটি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের এক অংশের নেতা। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আরেক অংশের। এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ এক অংশের এবং মোস্তফা জামাল হায়দার আরেক অংশের নেতা। সাম্প্রতিক ভাঙনে জি এম কাদের এখন অনেকটা কোণঠাসা। কারণ কাছের সবাই তাঁকে ছেড়ে নতুন পক্ষ তৈরি করেছেন। অবশ্য নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পার্টি এখনো জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুর নামেই আছে। আবার অনেকে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির বাক্সে আওয়ামী লীগের ভোট যাওয়ার সম্ভাবনার হিসাবও কষছেন। জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ না হয়ে যদি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে সে ক্ষেত্রে অনেকেরই আশায় গুড়ে বালি পড়তে পারে। অর্থাৎ ঘটনা একটা, প্রশ্ন অনেক। তবে প্রশ্ন হাজারটা থাকলেও নুরের ওপর যেভাবে হামলা হয়েছে, যেভাবে তাঁকে আহত করা হয়েছে, তা নিন্দনীয়।
নুরুল হক নুর ডাকসুর সাবেক ভিপি। স্বাধীনতার পর থেকে যাঁরা ডাকসুর ভিপি হয়েছেন তাঁদের মধ্যে নুরের যাত্রাটা অনেক কঠিন ছিল। অনেকেই বলেন, ছাত্রলীগ নুরকে পেটাতে পেটাতে ভিপি বানিয়েছে। অর্থাৎ নুর শারীরিক ও মানসিকভাবে এত নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যা অন্য কোনো ছাত্রনেতাকে হতে হয়নি। স্বাধীনতার পর ডাকসুর প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তারপর মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, আমান উল্লাহ আমান এবং সর্বশেষ নুরুল হক নুর। তাঁদের মধ্যে মাহমুদুর রহমান মান্না এবং নুর আলাদা রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর নুর তাঁর একসময়ের সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনাকে সালাম করার জন্য গণভবনে গিয়েছিলেন। সেদিনের বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেহারায় তিনি তাঁর মাকে খুঁজে পান। সেই মায়ের চেহারার নেত্রীর বিরুদ্ধেও নুর সোচ্চার হয়েছিলেন। ভিপি হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যম অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে গণমাধ্যম তাঁকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছিল। একদিন তিনি এক পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলেন নতুন একটি গাড়িতে চড়ে। ওই পত্রিকার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে শুভেচ্ছাবিনিময় শেষে যখন বিদায় নিচ্ছিলেন তখন সম্পাদক সাহেব সৌজন্য প্রদর্শন করে বলেছিলেন, ‘তুমি কোথায় যাবে, তুমি চাইলে আমার গাড়িতে করে যেতে পারো। ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।’ উত্তরে নুর বলেছিলেন, ‘ধন্যবাদ ভাই। আমার গাড়ি আছে।’ কৌতূহলবশত সম্পাদক জিজ্ঞেস করলেন, ‘নতুন গাড়ি? কিনেছো নাকি?’ উত্তরে নুুর বলেছিলেন, ‘না ভাই, কিনি নাই। আমার শুভাকাক্সক্ষীরা গিফট করেছেন।’ কয়েক মিনিট চুপ থেকে সম্পাদক বলেছিলেন, ‘তুমি খুব ভাগ্যবান ভিপি। তোমার শুভাকাক্সক্ষীরা তোমাকে নতুন গাড়ি গিফট করেছে। আর তোফায়েল ভাই, রব ভাই, সেলিম ভাই, মান্না ভাই, আখতার ভাইয়েরা রিকশায় চড়ে ভিপিগিরি করেছেন।’ এরপর কোনো কথা না বলে একটু হাসি বিনিময় করে সম্পাদকের কক্ষ ত্যাগ করেন নুর। ভিপি নুর সাহস করে অনেক সময় অনেক কথা বলেছেন। কখনো কঠিন সত্য বলেছেন, কখনো কখনো মতলবি কথাও বলেছেন বলে নিন্দুকেরা বলেন। সে কারণেই অপবাদ ও সমালোচনা তাঁর পিছু ছাড়েনি। তাঁর একসময়ের সহকর্মীদের কাছে তিনি ‘বিকাশ নুর’ নামেও পরিচিত। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সমাবেশে, টেলিভিশনে নুর যখন বক্তৃতা করেন তখন অনেকেই হাস্যরস করে বলেন, হয়তো সময়মতো ‘খাম’ আসেনি, ইত্যাদি। তবে আলোচনা-সমালোচনা যা-ই থাকুক না কেন, নুরের যদি প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটত তাহলে দেশের রাজনীতি কোন দিকে যেত, এর জন্য রাজনীতিবিদদের কতটা মূল্য দিতে হতো, ভাবলে শিহরিত হতে হয়।
এক বছরে দেশে নানা রকম খেলাধুলা হয়েছে। যে যেভাবে পেরেছে সেভাবেই খেলেছে। দিন যত যাচ্ছে খেলোয়াড়রা তত বেশি নষ্ট খেলা খেলছেন। এসব খেলায় জনগণ অতিষ্ঠ। তবে এখন দেশের স্বার্থে সবাইকেই খেলা থামাতে হবে। শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচন হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হবে। নির্বাচন বানচাল বা হতে না দেওয়ার মতো নষ্ট, বিপজ্জনক খেলা খেললে জনগণ আর বসে থাকবে না। অনেক হয়েছে, আর নয়, এবার জনগণের খেলার সময়। ফেব্রুয়ারির ভোটের খেলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে জনগণ।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন