অদ্ভুত এ জগৎ-সংসার আর বিচিত্ররূপী তার মানুষ। জীবনের উদ্দেশ্য কী, আর কেনইবা নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ততা? শুধুই কি খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্যই এ জীবন? নাকি রাতারাতি বিত্তশালী হওয়ার জন্য এ জন্ম!!! প্রতিনিয়ত অনেক প্রশ্নের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলি।
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী কবেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। সময়টি সুদীর্ঘ না হলেও খুব কম নয়। এ সময়ের মধ্যে আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের চমকপ্রদ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক উত্তরণ ঘটেছে। তারা তৃতীয় বিশ্ব থেকে প্রথম বিশ্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। আমাদেরও বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু উন্নতির সুফল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পায়নি। এর মুখ্য কারণ হলো লাগামহীন দুর্নীতি আর সুশাসনের অভাব। এ ছাড়া সামাজিকভাবে অপরাধপ্রবণতা, নারী ও শিশুর প্রতি নৃশংসতা, কিশোর গ্যাং, ছাত্র হত্যা, চাঁদাবাজি, অর্থ পাচার এগুলো যেন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মাদক এখন গুরুতর জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার সামান্য কিছু হয়তো গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সৌজন্যে আমরা দেখছি বা শুনছি। আর তাতেই আঁতকে উঠছি। এই অবক্ষয়ের পুরো চিত্রটা যে কতটা ভয়াবহ তা ভাবনার চেয়েও অনেক দূরে।
এ সমস্যাগুলোর শেকড় চিহ্নিত করে সত্বর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাজটি খুব কঠিন মনে হলেও সম্ভব। আর এখনই উপযুক্ত সময়। দীর্ঘদিন ধরে হতাশাগ্রস্ত মানুষ একটু স্বস্তি ও শান্তির জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। কারণ মানুষ এখন উত্তরণ চায়। কবে আসবে সেদিন যেদিন আমাদের দেশ দুর্নীতিমুক্ত দেশের তালিকায় নাম প্রকাশিত হবে।
বিখ্যাত মার্কিন লেখক জেমস হেনরি বলেছেন, মানবজীবনে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, উদার হওয়া, দ্বিতীয়ত, উদার হওয়া, তৃতীয়ত, উদার হওয়া। পৃথিবীর মানুষ দিন দিন কেন জানি অধিকতর অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। দয়ামায়া, উদারতা, মানবিকতা, সহনশীলতা, ক্ষমাশীলতা এসব যেন আজকাল সোনার পাথর বাটি। সারা বিশ্বের কথা না হয় বাদই দিলাম। একসময় এ দেশের মানুষের হৃদয়ের যে সুনাম ছিল তা কি আর এখন আছে? সাম্প্রতিককালে আমাদের অসহিষ্ণুতার অভিজ্ঞতা বড়ই দুঃখজনক। আসলে আত্মকেন্দ্রিকতা এবং আর্থিক বৈষম্য যত বাড়ছে ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতার বিষয়টি ততই প্রকট হয়ে উঠছে। হিংসা-বিদ্বেষ আর পরশ্রীকাতরতা এক মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। এ ব্যাধি রয়েছে ব্যক্তিবিশেষে, পরিবারে, সমাজে তথা রাষ্ট্রের সর্বত্রই। আমাদের দেশে যেন এর চাষবাস দিন দিন বেড়েই চলছে।
একবার এক ব্যবসায়ী মালবাহী ট্রেনে ড্রামভর্তি কাঁকড়া নিয়ে যাচ্ছিলেন। ড্রামের ঢাকনা খোলা দেখে এক সহযাত্রী বললেন, কাঁকড়া তো বের হয়ে যাবে। উত্তরে ব্যবসায়ী বললেন, ঢাকনা খোলা থাকলেও কাঁকড়াগুলো বের হতে পারবে না। সহযাত্রী জানতে চাইলেন, কেন বের হতে পারবে না? ব্যবসায়ী হেসে উত্তর দিলেন, কোনো কাঁকড়া বের হতে চাইলে বাকিরা এর হাত-পা টেনে ধরে নিচে নামাবে। আসলে হিংসা হচ্ছে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। শুধু মানুষ কেন, সৃষ্টি জগতের কোনো জীবই এ থেকে মুক্ত নয়। কাঁকড়াও মুক্ত নয়। পা টেনে ধরে নিচে নামাতে যেন তার জুড়ি নেই।
কথায় আছে, বন্ধু যদি ফেল করে বা অকৃতকার্য হয় তাহলে কষ্ট লাগে, কিন্তু বন্ধু যদি ফার্স্ট হয় তাহলে আরও বেশি কষ্ট লাগে। এই কষ্ট লাগার বিষয়টিই হচ্ছে হিংসা বা ঈর্ষা। আমাদের চারপাশে কত শত মানুষ। প্রতিটি মানুষের বাইরের চেহারার মতো ভিতরের চেহারাও আলাদা আলাদা। কেউ কারোর মতো নয়। মনটাও ঠিক তাই। কারোরটা কারোর মতো নয়। এ পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যাদের সংস্পর্শে এলে জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আবার কারো সান্নিধ্য পেলে জীবনের রংটাই পাল্টে যায়। মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। জীবন হয়ে উঠে অর্থবহ।
ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতা- এ শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। আমাদের চারপাশের মানুষজন, যারা আমাদের সমমানের তাদের সঙ্গেই আমাদের ঈর্ষা তথা হিংসার ব্যাপারগুলো ঘটে। নিজের অজান্তেই ঈর্ষার আগুনে দগ্ধ হতে থাকি। কিন্তু এই নীরব ঘাতক ঈর্ষা যে আমাদের মনের প্রশান্তি কেড়ে নিচ্ছে সে ব্যাপারে আমরা কতটুকু সচেতন? সত্যি কথা বলতে কী, বর্তমান যুগ ইঁদুর দৌড়ের যুগ। এর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন যেন টালমাটাল। অস্থিতিশীল পরিবার ও সমাজ সৃষ্টির জন্য আমরা সব সময়ই চারপাশের পারিপার্শ্বিকতাকে দোষ দিয়ে থাকি। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে আমি কি ঠিক আছি? আমি কি আমার ভিতরকার রিপুগুলো নিয়ে সচেতন? আমাদের এ অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার প্রবণতাকে আমরা কি পারি না নিয়ন্ত্রণে রাখতে?
ঈর্ষা জিনিসটা মানুষের অজান্তেই কাজ করে। পরিচিত বন্ধুবান্ধব কারও কোনো সুখবরে আমরা অভিনন্দন জানাই ঠিকই, কিন্তু অন্তরে জ্বালা ধরে। আমার নিজের মধ্যেও হিংসা বা ঈর্ষা জিনিসটা কাজ করে। তবে তা কাঁকড়ার মতো পা টেনে ধরে নিচে নামানোর পর্যায়ে না পড়লেও সাময়িকভাবে মনটা খারাপ হয়ে যায়, যা সামলে নিতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। মানুষের জীবনটা কতই না ছোট!!! যতটা ভাবি তার চেয়েও ছোট। অথচ ঈর্ষা যেন আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। কিন্তু যখন একজন বড় মাপের মানুষের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করি তখন বুঝি আমি কত তুচ্ছ, কত সামান্য। এই পৃথিবীতে এলাম আকস্মিক, রূপ-রস গ্রহণ করলাম তারপর চলে যাব আকস্মিক। পৃথিবীকে কী দিয়ে গেলাম। যখন একা থাকি এ ভাবনাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
আমরা সব সময় জিততে চাই। নিজের বড়ত্ব জাহির করতে মরিয়া হয়ে উঠি। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করি আমার অনেক ক্ষমতা। কথায় কথায় রিকশাওয়ালার কলার ধরি। বাসের হেলপারের গায়ে হাত তুলি। সুযোগ পেলেই গরিবকে হেয় করি। কেন যেন অন্যকে ছোট করে এক ধরনের আনন্দ অনুভব করি। এসব হিরোগিরি করতে গিয়ে যে নিজেও মাঝেমধ্যে অন্যের দ্বারা অপমানিত হই না তা কিন্তু নয়। মানুষের খারাপ ব্যবহার আমাকে কষ্ট দিলেও, আমার খারাপ ব্যবহারে যে মানুষও কষ্ট পেতে পারে তা অনুভব করি না। বরং মনে মনে ভাবি, নিজের মাঝে উগ্রতা ফুটিয়ে তুলতে পারলে লোকে ভয় পাবে। ভক্তি করবে, সালাম দেবে। বন্ধুরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে, বাহবা দেবে। আমার সাহসের প্রশংসা করবে। তাতে আমার আনন্দ আরও বেড়ে যাবে।
তাই তো এ ধরনের মানসিকতার জন্যই আমরা কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাই না। ফলে ছোট ছোট ছাড়ের অভাব বড় বড় দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। চায়ের কাপের ঝগড়া রূপান্তরিত হয় সংঘর্ষে। অথচ কোনো এক পক্ষের সামান্য ভুল স্বীকার হয়ে উঠতে পারত সুন্দর সমাধান। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ঝামেলা সৃষ্টিতে উভয় পক্ষই কমবেশি দায়ী থাকে। অনেক সময় মানুষ না জেনেও ভুল করে থাকে। অনভিজ্ঞ হওয়ার দরুন অপ্রত্যাশিত ভুল হতেই পারে। কারণ সব সময় সবকিছু জানার বা বোঝার সুযোগ হয়ে উঠে না।
আবার যদি অন্যদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তাহলে দেখি, বিশ্বময় এই দুঃসময়েও মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলছেন এমন দয়ালু ও হৃদয়বান লোকও সমাজে রয়েছে। তাদের উদারতা ও মানবিক সাফল্যের গল্প শুনে বুকটা ভরে ওঠে। তখন মনে হয় হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা এসব ঝেড়ে মুছে ফেলে নিজেকে মানবতার সেবায় উৎসর্গ করি। মনের সমূহ সংকীর্ণতা দূর করে আজ থেকেই শুরু করি উদারতার অনুশীলন। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? এর জবাব তো দিয়েই গেছেন কবি সুনির্মল বসু- ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাইরে।’
এ পৃথিবীতে ভালো মানুষও আছে, যাদের হৃদয় অসাধারণ। যারা কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যাদের খুব কাছে থেকে না দেখলে বোঝা যায় না তাদের মনের উদারতা কতটা গভীর। স্বার্থপরতা কখনই তাদের কলুষিত করতে পারে না। আজকে তেমনি একজন মানুষের কথা তুলে ধরব যা অনেকের জীবনকে বদলে দিতে পারে। এই উপমহাদেশে বিধবা বিবাহ নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু বিধবা তরুণীকে যদি তার শাশুড়ি আবার বিয়ে দেন তাহলে তো চোখ কপালে ওঠারই কথা!!! মনে প্রশ্ন জাগে, এমন উদার মনের মানুষ কী পৃথিবীতে আছেন? বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মাথায় ব্রেন স্ট্রোকে ছেলের মৃত্যু হলে পুত্র শোকাতুর মা ছেলের মৃত্যুকে ভাগ্য বলে মেনে নেন এবং পুত্রবধূকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। মায়ের মমতায় লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে তাকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেন। তারপর তাকে ফের বিয়ে দেন। সাধারণত এত অল্প সময়ের মাথায় স্বামী মারা গেলে সদ্য বিধবার কপালে নানা দুঃখ লেখা থাকে। স্বামীর মৃত্যুর জন্য বিধবা মেয়েটিকে দায়ী করা হয়। তাকে অপয়া বলা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি।
এ বিরলতম ঘটনাটি কিন্তু আমাদের দেশেই ঘটেছে। গাইবান্ধা জেলার অন্তর্গত সাদুল্লাপুর উপজেলার পাকশী গ্রামে। স্থানীয় সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা সালমা খাতুনের এমন উদারতা নেটদুনিয়ায় ভাইরাল না হলেও আশপাশের গ্রামসহ পাড়া-প্রতিবেশীদের মুখে মুখে। প্রশংসার বন্যায় যেন তিনি ভাসছেন। এ অন্যরকম শাশুড়ির গল্প নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো সিনেমা হবে কি না জানি না, তবে মানুষের হৃদয়ে তিনি থেকে যাবেন অনেক দিন।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক