ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে ২০২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলে ভৌগোলিক কারণে অবশ্যই এর অবস্থান বর্তমান স্থানে হতো না। মানসম্মত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় জনবহুল ও বাণিজ্যিক পরিবেশে গড়ে ওঠার নজির নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু শ্রেণি কার্যক্রমের গণ্ডির মধ্যে বিবেচনা করা কোনোভাবেই সমীচীন হয় না। শিক্ষার্থীদের পূর্ণমাত্রায় আবাসিক সুবিধা ও অবকাঠামো না দিতে পারলে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার দৈন্য থেকে কোনোভাবেই বের হয়ে আসা যাবে না। তবে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির খাতিরে তৈরি করা হলে সেটি ভিন্ন বিষয়, যা সনদপত্র ও নামসর্বস্ব হতে বাধ্য। ইতোমধ্যে এটি দৃশ্যমান হয়েছে, বিগত সরকারের প্রতি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগটি শিক্ষার মানোন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই যেনতেন প্রকারে জনবহুল কর্মব্যস্ত শহরের প্রাণকেন্দ্রে স্বল্প জায়গায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিপক্ষে সচেতন জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর ক্রমশ স্পষ্টতর হচ্ছে।
কয়েক মাস আগে একটি সংবাদপত্রের কলামে প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে লিখেছিলাম, ‘ভবিষ্যতে প্রতিটি ক্যাম্পাস স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পৃথকীকরণের দাবি তুললে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।’ লেখাটি প্রকাশের এক মাসের মধ্যে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের কলেজকে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়’-এর অধীনে মেনে নেবেন না মর্মে জানিয়েছেন। তারা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় চান। কারণ তারাও হয়তো বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত এ ধরনের সাতটি ক্যাম্পাস নিয়ে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে জগন্নাথের ছায়া দেখতে পেয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আন্দোলনকারীদের বাইরে যারা সাধারণ শিক্ষার্থী তাদের মতামত নেওয়া ও মনোভাবের মূল্যায়ন প্রতিফলিত না হলে এরূপ ঘটনা ঘটতেই থাকবে। ক্রমান্বয়ে অন্য ক্যাম্পাসগুলো নিকটভবিষ্যতে ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু তৈরি করে ডিসিইউ থেকে বের হয়ে যেতে চাইবে। এভাবে একসময় হারাধনের ছেলেদের মতো ডিসিইউ অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যেতে পারে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যাগুলো হলো আবাসিক সমস্যা, নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণে কালক্ষেপণ, বাজেটের অপর্যাপ্ততা। লক্ষণীয় বিষয়, এ সমস্যাগুলোর উদ্ভব হয়েছে শুধু জগন্নাথ কলেজকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের কারণে এবং দীর্ঘ ২০ বছরেও সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়নি। অপরদিকে নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে স্থাপিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব সমস্যা নেই বললেই চলে। যেখানে একটি কলেজ জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব হচ্ছে না, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেখানে সাতটি কলেজের সাতটি পৃথক ক্যাম্পাস নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। আবার বিবেচ্য সাত কলেজের কোনো ক্যাম্পাস বা ক্যাম্পাসের ভূমির অংশবিশেষ যদি কোনো দাতা কর্তৃক ওয়াক্ফকৃত হয়ে থাকে তাহলে ওই ওয়াকফ্-এর শর্তাবলি বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক। কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে বা প্রতিষ্ঠানে ওয়াক্ফকৃত ভূমি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বা প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর করা হলে ওয়াক্ফ অধ্যাদেশ, ১৯৬২ এবং ওয়াক্ফ (সম্পত্তি হস্তান্তর ও উন্নয়ন) বিশেষ বিধান আইন, ২০১৩-এর ধারা ৫ উপধারাসমূহের ব্যত্যয় ঘটে কি না, সে বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে বঞ্চিত হতে পারে।
আবার সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে এসব কলেজের বঞ্চিত প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী অতি অল্প খরচে অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে লেখাপড়ার সুযোগ হারাবেন। এদের মধ্যে অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা ছুটবেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে- যা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে। ফলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক প্রসার ঘটবে উচ্চমাত্রায় আর শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারগুলো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এ ক্ষেত্রে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি এবং অদক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। জনশক্তি রপ্তানি ও শ্রমবাজারে এর বিরূপ প্রভাব অবশ্যম্ভাবীভাবে গোচরীভূত হবে। বেকারত্বের পাশাপাশি ছদ্মবেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাবে। অদূরভবিষ্যতে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত রেমিট্যান্স তথা সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর ঋণাত্মক প্রভাব দৃশ্যমান হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সার্বিক বিবেচনায় সাত কলেজ এখন শিক্ষাচিন্তকদের ভাবনার পাশাপাশি অর্থনীতিবিদদের ভাবনায়ও জায়গা করে নিচ্ছে। আন্দোলনকারী এবং সাধারণ মানের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অভিভাবকদের কাছে ক্রমান্বয়ে সমস্যার প্রকটতা স্পষ্টতর হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডিসিইউর লোগো বা মনোগ্রাম প্রকাশ, অধ্যাদেশ জারি ও প্রশাসক নিয়োগ করে শিক্ষার্থীদের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে এনরোলমেন্ট করার পাশাপাশি বৃহৎ একটি জায়গা নির্ধারণ করে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অগ্রাধিকার প্রকল্প গ্রহণ করা হোক। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার্থীরা নতুন অত্যাধুনিক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত শিক্ষার্থী হওয়ার সুযোগ পাবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের একটাই প্রত্যাশা ডিসিইউ যেন সমস্যাসংকুল আরও একটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিরূপ না হয়ে ওঠে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, কবি ও কলামিস্ট