গত জানুয়ারির মাঝামাঝি এক শীতের সকালের কথা। তখন বগুড়ার সারিয়াকান্দির কালীতলা ঘাট থেকে রওনা হয়েছি যমুনার চরের দিকে। বাংলাদেশের অনেক নদীর মতোই যমুনার স্বরূপও বদলে গেছে। নদীর বুকে পানির সংকট, বালুতে ভরাট হয়ে গেছে অনেকাংশ। কালীতলা ঘাটে তবু কিছুটা প্রাণচঞ্চল্য চোখে পড়ে। মাছ ধরতে নামছে কেউ, কেউবা নৌকা প্রস্তুত করছে পাড়ি দেওয়ার জন্য। এখান থেকেই আমরা রওনা হই যমুনার কর্নিবাড়ি চর অভিমুখে, যেখানে গড়ে উঠেছে একটি ব্যতিক্রমী অথচ চিরায়ত কৃষিভিত্তিক জীবনচর্চা, মহিষের বাথান।
নৌকা করে যেতে যেতে বদলে যেতে থাকে নদীতীরের প্রাকৃতিক দৃশ্যপট। নদীতে এখন শীতল, হিমেল হাওয়া বইছে। উজান থেকে আসা পানির গতি অনেক কমে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, নদীশাসন আর খরার ফলে আমাদের বহু নদী ঐতিহ্য হারিয়েছে। শুকনো মৌসুমে অনেক নদীকেই এখন মনে হয় যেন ছোট কোনো খাল কিংবা নালা। তবে এই প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও বেঁচে থাকার, টিকে থাকার এক অনন্য উপায় খুঁজে নিয়েছেন এ এলাকার কিছু লোক। তাঁরা চরের বুকজুড়ে গড়ে তুলেছেন মহিষের বাথান, যা চরাঞ্চলের মানুষের জন্য হয়ে উঠেছে একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক বলয়।
দূর থেকেই চোখে পড়ে নদীর চরে বিশাল এক মহিষের পাল। ওটিই কর্নিবাড়ি চর। নৌকা চরে ভিড়তেই স্বাগত জানালেন বাথানপ্রধান আমিরুল ইসলাম। বয়স ষাটের কাছাকাছি। দোহারা গড়ন, দেখে বয়স বোঝা যায় না। প্রায় ৪০০ মহিষ নিয়ে বাথান পরিচালনা করছেন আমিরুল ইসলাম। প্রথম দর্শনেই বোঝা গেল, দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় গড়া একজন কৃষিজীবী মানুষের আত্মবিশ্বাস ও উদারতা তাঁর চোখমুখে। চরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমিরুল বললেন, ‘এই মহিষগুলোর অনেকগুলো আমার নিজের, আবার অনেকগুলো এসেছে আশপাশের গ্রামের মানুষের কাছ থেকে বার্ষিক চুক্তিতে। আমি এগুলোকে ৭-৮ মাস এখানে চরিয়ে রাখি, দুধ নিই, যত্ন করি। পরে ওদের ফেরত দিয়ে দিই।’
আমিরুলের কণ্ঠে শোনা গেল গর্ব। তাঁর ভাষায়, ‘আমার বাবা ছিলেন এই পেশায়, আট বছর বয়স থেকে আমি শুরু করেছি তাঁর হাত ধরে। আমরা চাই এই জীবনধারা টিকে থাকুক, আরও বড় হোক।’ কথাগুলো বলার সময় তাঁর চোখে দেখেছি একধরনের দায়বদ্ধতা এবং ভালোবাসার ছাপ স্পষ্ট।
যমুনার চর মূলত বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক অঞ্চল, যেখানে নদী শুধু স্রোতের গতিপথ নয়, বরং জীবনের নীরব ধারক। সেই জীবনেরই একটি স্তর চরের বাথানে ঘুরে বেড়ানো মহিষ। প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ এরা, তবে তাদের আচরণে আছে একধরনের বুনো সৌন্দর্য, সতর্কতা আর আত্মমর্যাদা।
সকালের সূর্য ইতোমধ্যে মাথার ওপরে উঠতে শুরু করেছে, কিন্তু চরজুড়ে মহিষদের চলাফেরায় কোনো তাড়াহুড়া নেই। কাছ থেকে তাকালে বোঝা যায়, প্রতিটি মহিষ যেন একেকটি আলাদা চরিত্র। বিশেষ করে চোখের ভাষা। বুনো, তীক্ষè, সতর্ক। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে কয়েকটি মহিষ স্থির হয়ে যায়। একটির চোখে চোখ পড়তেই বুঝতে পারি, আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে। আমিরুল বলছিলেন, ‘চোখে চোখ পড়লে মহিষ যদি চাহনি না সরায়, বুঝবেন ওটা নেতা টাইপ। নিজের এলাকা কেউ দখল করুক, চায় না।’ তবে আমাদের আশ্বস্ত করলেন, তিনি আছেন, কিছু হবে না। বাথানের মাঝখানে ছোট করে তোলা ঝুপড়িঘর। ওখানেই রাখালদের সংসার। রাখালরা সর্ষের তেল মেখে খিচুড়ি খাচ্ছিলেন। কেউ থালায়, কেউ বোলে, এমনকি কেউ ছোট বালতিতে করেই সারছিলেন সকালের নাশতা। তাঁদের খিচুড়ি খাওয়া দেখে আমার খুব লোভ হচ্ছিল। একে তো শীতের সকাল, তারপর তখনো নাশতা হয়নি। মনে পড়ে গেল কয়েক শীত আগে যশোরের খাজুরা গ্রামে কিছু কৃষক বাঁধাকপি তুলছিলেন, আমি তাঁদের নিয়ে কাজ করছিলাম।
কাজের এক ফাঁকে কিষানি এক গামলা খিচুড়ি, এক জগ পানি, আর ১০-১২টা থালা নিয়ে মাঠে হাজির হলেন কৃষিশ্রমিকদের দুপুরের খাবার দিতে। আমাকেও আমন্ত্রণ জানালেন তাঁদের সঙ্গে খাওয়ার জন্য। কিন্তু তার আগেই আমি দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছিলাম। তবে কিষানির এমন সহজ আমন্ত্রণ ফেলতে পারলাম না। মাঠে তাঁদের সঙ্গে খেতে বসে গেলাম। কিষানি যখন খিচুড়ির থালায় সরিষার তেল ঢেলে দিলেন, খাঁটি সরিষার ঝাঁজে পেটে আবার ক্ষুধা জেগে উঠল। আহ! সে কী স্বাদ, মোটা চালের গরম খিচুড়ি আর সরিষার তেলের! আজকে এই বাথানে তাঁদের খাবার দেখে এগিয়ে গেলাম। পেটেও ক্ষুধা আছে। তাঁদের সঙ্গে কুশলবিনিময় করলাম। কিন্তু কেউ খেতে সাধল না। চরের কৃষক তো, কঠিন মনের মানুষ! কিংবা হয়তো ভেবেছে, সাধলে খাব না।
যমুনার বিস্তীর্ণ চরে থাকা এই বাথানগুলোর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। বছরের শুষ্ক সময় অর্থাৎ প্রায় সাত থেকে আট মাস চরজমিতে যথেষ্ট পরিমাণ ঘাস মেলে। মহিষের জন্য এটি আদর্শ আবাসস্থল। রাখালরা নদীপাড়ি দিয়ে চরে চলে আসেন, ঝুপড়িতে গড়ে তোলেন অস্থায়ী বসতি। তাঁরা প্রতিদিন মহিষ চরান, দুধ দোহান, নৌকায় করে তা পাঠান শহরের বাজারে। বাকি সময়গুলোতে, অর্থাৎ বর্ষার তিন থেকে চার মাস, তারা ফিরে যান নিজ নিজ গ্রামে।
এই পুরো ব্যবস্থাটি চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় যথেষ্ট শৃঙ্খলাবোধ ও অভিজ্ঞতা। শুধু চরের ঘাসে হয় না, মহিষদের জন্য দানাদার খাদ্যও সরবরাহ করতে হয়। তাদের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য টিকা ও ওষুধের ব্যবস্থাও করতে হয়। একেকটি বাথানে সাধারণত ৩০০ থেকে ৫০০টি পর্যন্ত মহিষ পালন করা হয়। চমকপ্রদ বিষয় হলো, এই মহিষগুলোর রয়েছে নিজস্ব নাম। কেউ কালু, কেউ রাজা, কেউবা ধবলা। রাখালরা নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় মহিষরা। একসময় যে চরগুলো ছিল জনশূন্য, সেই জায়গাগুলোই এখন হয়ে উঠেছে কর্মচঞ্চল খামার।
আমরা কথা বলি আরেকজন অভিজ্ঞ রাখালের সঙ্গে, নাম নিরঞ্জন ঘোষ। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। শীতল বাতাসে তাঁর কণ্ঠ যেন কিছুটা ভারী, তবে স্মৃতিমেদুরতায় ভরা। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা মহিষ পালন করতেন, আমিও সেই কাজ ধরে রেখেছি। একেকটা মহিষকে আমি ছেলের মতো চিনি। কোনটা কখন কী খেতে চায়, কখন অসুস্থ হয়, সব বুঝি। এই পেশাতেই আমি ভালো আছি। তবে আমার ছেলেপেলেরা এই পেশায় আসতে চায় না।’
রাখালদের জীবন খুব সহজ নয়। চরের নির্জনতায় থাকতে হয় মাসের পর মাস। বৈরী আবহাওয়া, নদীভাঙনের শঙ্কা, কিংবা হঠাৎ করে মহিষের অসুস্থতা, সবই সামাল দিতে হয়। তবু তাঁরা এই পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন। কারণ এটি তাঁদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে, যেমনটি বললেন আমিরুল, ‘অনেক ঝুঁকি আছে ঠিকই, কিন্তু লাভও কম নয়। মহিষের দুধের বাজার ভালো, আর এই পেশায় খরচ তুলনামূলক কম।’
সকালে দুধ দোহানোর পর নৌকায় করে পৌঁছে যান জামালপুরের মাদারগঞ্জে মিল্ক ভিটায়। এ বাথানে যে এই কাজটি করেন তাঁর নাম নূরুল হক। প্রায় চল্লিশ বছর তিনি এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। বাথানগুলোর আর্থিক পরিধিও অনেক বড়। একেকটি মহিষ দিনে ২৩ লিটার দুধ দেয়। বড় বাথানে দৈনিক উৎপাদন হতে পারে প্রায় হাজার লিটারের মতো। স্থানীয় বাজারে এই দুধ সরাসরি বিক্রি হয় অথবা দুগ্ধশিল্পের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত হয়। এতে একদিকে যেমন রাখালরা আয় করছেন, অন্যদিকে শহরের মানুষের জন্য আসছে পুষ্টিকর দুধের জোগান।
তবে বিগত সময় যতটা ভালো গেছে, এই সময় ততটা ভালো যাচ্ছে না বলে মত দিলেন আমিরুল ইসলাম। তিনি আট মাসের জন্য ৩৫ লাখ টাকায় লিজ নিয়েছেন এই চর। এর মাঝে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে গো-খাদ্যের দাম। সব মিলিয়ে লাভ-লোকসানের হিসাবটা করা সহজ হচ্ছে না।
শঙ্কায় আছেন এই বছরের হিসাবনিকাশ নিয়ে। বলছিলেন, এই পেশার উন্নয়নে রয়েছে অনেক সম্ভাবনা, যদি তা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সহায়তা পায়। চরজমিতে বিদ্যুৎ ও পানির সহজলভ্যতা, স্বাস্থ্যসেবা, পশুচিকিৎসা, দুধের হিমায়িত সংরক্ষণব্যবস্থা এবং বাজারজাতকরণে আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন। তাতে শুধু মহিষ পালনের পেশাটাই লাভজনক হবে না, বরং তা হয়ে উঠবে একটি টেকসই এবং আধুনিক কৃষি উদ্যোগ।
আজকের দিনে যেখানে অনেক তরুণ শহরমুখী, গ্রামীণ পেশাগুলোকে তুচ্ছ মনে করছে, সেখানে এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী পেশা ধরে রাখা ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে তোলা অত্যন্ত জরুরি। নীতিনির্ধারক ও উন্নয়নকর্মীদের উচিত হবে এই কর্মঠ, সাহসী মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, যাতে তাঁরা আরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন।
সারিয়াকান্দির কর্নিবাড়ি চর এবং এর মতো আরও অনেক চরজমি প্রমাণ করছে, বাংলাদেশের কৃষি আজও শক্তিশালী। শুধু প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তব সহায়তা। নদীর বুকে গড়ে ওঠা এই নীরব বিপ্লব আমাদের শেখায় উদ্যোগ, শ্রম আর সাহস থাকলে প্রতিকূলতাকেও জয় করা যায়।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব