ড. সিরাজুল হক ছিলেন একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক ও জ্ঞানতাপস। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি অল্পসংখ্যক কালজয়ী শিক্ষাবিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। সারা জীবন জ্ঞানচর্চা ও সাধনায় নিজেকে আত্মনিবেদিত করেছেন। ড. সিরাজুল হক ১ এপ্রিল ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৫ মাঘ ১৩০৮ বঙ্গাব্দে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ভোলাকোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর বাবা মৌলভী মুহাম্মাদ হামিদউল্লাহ পাটওয়ারী এবং মা মাইমুনা খাতুন। ড. সিরাজুল হকের বাবা ছিলেন একজন আলেম। নিজ পরিবারে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়। এরপর তিনি রামগঞ্জের ভাট্টা মাদরাসায় ভর্তি হন।
তিনি দৌলতপুরে কারি ইবরাহিম (রহ.)-এর কাছে কোরআন মাজিদ ও তাজবিদ অধ্যয়ন করেন।
ড. সিরাজুল হক ১৯১৭ সালে ঢাকার প্রসিদ্ধ ‘মুহসিনিয়া মাদরাসায়’ (বর্তমান কবি নজরুল কলেজ) ভর্তি হন। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে ঢাকা বোর্ডের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
তিনি ১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হন। ১৯২৬ সালে বিএ অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান এবং ১৯২৭ সালে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। ১৯৩০ সালে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ফারসি বিভাগ থেকে এমএ পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ড. হক তৎকালীন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রধান ড. জে ডব্লিউ ফুইকের কাছে জার্মান ভাষা শেখেন। ড. হক ১৯৩৫ সালে পিএইচডি গবেষণার জন্য লন্ডন যান এবং ১৯৩৭ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’ থেকে ‘Ibn Taimiya and his projects of Reform’ শীর্ষক বিষয়ে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণাকর্মের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ওরিয়েন্টালিস্ট স্যার হেমিল্টন এ আর গিব।
১৯২৭ সালে এমএ পাসের পর ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট ড. সিরাজুল হক আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৫ সালে পিএইচডি গবেষণার জন্য ছুটি নিয়ে বিদেশ যান এবং ফিরে এসে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫১ সালের ২৮ জুলাই প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৫১ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর তিনি আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে ৩০ জুন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে নিযুক্ত করে।
ড. সিরাজুল হক কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্নভাবে সম্মানিত হয়েছেন। যেমন—
১. ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘সিতারায়ে ইমতিয়াজ’ খেতাব দেয়।
২. ১৯৮৬ সালের ২৬ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান ও কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ১৯৮৩ সালের স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
৩. ১৯৯৭ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন।
ড. হক দেশ-বিদেশে বহু সভা-সেমিনার ও কনফারেন্সে যোগ দিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে—
১. ১৯৩৬ সালে জার্মানির ‘বন’ শহরে International Oriental Conference অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে ড. সিরাজুল হক অংশ নেন।
২. ইউনেসকোর উদ্যোগে ১৯৫৩ সালে নাওয়ারা ইলিয়া, সিলনে (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) অনুষ্ঠিত Contribution of Modern Languages towards living in a world Community শীর্ষক সেমিনারে ড. সিরাজুল হক পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে অংশ নেন এবং The Teaching of Arabic in Pakistan শিরোনামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন।
৩. ১৯৫৬ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ‘উলামা ডেলিগেট’ হিসেবে মাসব্যাপী এক সফরে চীন গমন করেন। এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল চীনের মুসলমানদের অবস্থা স্টাডি করা এবং সেখানকার মসজিদগুলো পরিদর্শন করা।
ড. সিরাজুল হক গবেষণা কার্যক্রমেও অসামান্য অবদান রেখেছেন। মৌলিক ও অনূদিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ এবং মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা ২০-এর অধিক।
বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ ২০০৫ সালের ৪ এপ্রিল দুপুরে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার সোবহানবাগ কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জ্যেষ্ঠ কন্যা মাহযূযা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল