ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে গ্যাস সিলিন্ডার রিফিল করার বহু প্রতিষ্ঠান। মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের এসব সিলিন্ডারে গ্যাস রিফিল কিংবা সরবরাহ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিভিন্ন সময় বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও থেমে নেই অবৈধ এসব কারখানার কাজ। প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে যেন বেখবর।
তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) তুলনায় অবৈধ এসব রিফিল গ্যাস কম দামে পাওয়া যায় বলে ঝুঁকি বিবেচনা না করেই এসব সিলিন্ডার কিনছেন ভোক্তারা। এতে ঘটতে পারে প্রাণহানির মতো বড় দুর্ঘটনা।
এ রকমই একটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া গেছে কেরানীগঞ্জ উপজেলায় প্রশাসনের ‘নাকের ডগায়’। মো. মাশফুক ববি (৫৫) নামের এক ব্যক্তি উপজেলা পরিষদের পেছনে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের পাশে রাজাবাড়ি সড়কে স্যাটেলাইট এলপিজি প্লান্ট নামের একটি অবৈধ গ্যাস রিফিল প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন।
সেখানে তিনি প্রতিদিন বসুন্ধরা এলপি গ্যাস, ফ্রেশ, ইউনি গ্যাস, আই গ্যাস, গ্রিন এলপিজি, সেনা এলপিজি, বেক্সিমকো, পেট্রোম্যাক্স, ওমেরা, সান গ্যাস, জেএমআই, বিএম, যমুনা, বেঙ্গল, নাভানা, ডেল্টা গ্যাসসহ দেশের বিভিন্ন কম্পানির কয়েক শ সিলিন্ডার গ্যাস গোপনে অবৈধভাবে রিফিল করে থাকেন। এতে যেমন দেশের খ্যাতনামা কম্পানিগুলোর বাজারে সুনাম নষ্ট হচ্ছে, তেমনি সরকার প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার কর ও ভ্যাট থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্থানীয় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায়ীরাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে রিফিলকৃত পণ্যের ওজন সঠিক না থাকায় প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা।
খবর পেয়ে কেরানীগঞ্জ উপজেলা এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী সমিতির কর্মকর্তারা বিভিন্ন কম্পানির কর্মকর্তা এবং ডিলার বা পরিবেশকদের নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। তবে প্রতিষ্ঠানটির মূল ফটক বাইরে থেকে তালাবদ্ধ দেখতে পাওয়া যায়। অনেক চেষ্টা করেও সেখানে প্রবেশ করা যায়নি। যেসব কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন তাঁরা হলেন বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের বিভাগীয় কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান, জেএমআই গ্যাসের এজিএম আজাদ, গ্রিন এলপি গ্যাসের সিনিয়র ম্যানেজার আবুল হোসেন, টোটাল এলপি গ্যাসের ডিএসএম শাহাদত, ইউনি এলপি গ্যাসের এএসএম রায়হান, টিএমএসএস এলপি গ্যাসের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সেলিম রেজা, ফ্রেশ গ্যাসের এক্সিকিউটিভ রিমন, ডিলারদের মধ্যে রয়েছেন নুর এন্টারপ্রাইজের নুরে আলম আঁখি, সামিয়া এন্টারপ্রাইজের বিল্লাল হোসেন, নিউ গাজী এন্টারপ্রাইজের আলামিন, কেরানীগঞ্জ ট্রেডার্সের মাসুদ রানা, রাজা এন্টারপ্রাইজের জাকির হোসেন, জসিম এন্টারপ্রাইজের জসিম, আনিস এন্টারপ্রাইজের মাসুম মিয়া, নিলয় এন্টারপ্রাইজের নাসির উদ্দিন ডালিম, মাশরিফ এন্টারপ্রাইজের ইলিয়াস মিয়া, বাবর কমপ্লেক্সের আরিফ মুহাম্মদ, রামিশা এন্টারপ্রাইজের রিপন, বাবুল অ্যান্ড কম্পানির শাহীন আখতার ও আলম এন্টারপ্রাইজের বদিউল আলম।
সেখানে কথা হয় স্থানীয় মো. আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। অবৈধ গ্যাস রিফিলিং কম্পানি সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি এ এলাকায় ৩৫ বছর যাবৎ মাতবরের বাড়িতে বসবাস করি। আমি শুনেছি, এই কম্পানির জায়গাটি এক লোক ভাড়া নিয়ে বোতলে গ্যাস ভরে। তারা দিনের বেলায় কম কাজ করে, রাতে বেশি কাজ করে থাকে। এই কম্পানি বৈধ না অবৈধ সেটা আমি জানি না। এ ছাড়া এসব কারখানায় ছোটখাটো অনেক দুর্ঘটনা ঘটলে মালিকপক্ষ তা ধামাচাপা দেয় কিংবা ‘ম্যানেজ’ করে ফেলে।”
কেরানীগঞ্জ উপজেলা এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘আমি সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছি। কেরানীগঞ্জের বোয়ালী এলাকার মো. মাশফুক ববি স্যাটেলাইট এলপিজি প্লান্ট নামের একটি অবৈধ প্রতিষ্ঠান তৈরি করে অজ্ঞাতপরিচয় লোকজন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসুন্ধরা এলপি গ্যাস, ফ্রেশ, ইউনি গ্যাস, আই গ্যাস, গ্রিন এলপিজি, সেনা এলপিজি, বেক্সিমকো, পেট্রোম্যাক্স, ওমেরা, সান গ্যাস, জেএমআই, বিএম, যমুনা, বেঙ্গল, নাভানা, ডেল্টাহ দেশের খ্যাতনামা বিভিন্ন কম্পানির সিলিন্ডার গ্যাস গোপনে অবৈধভাবে রিফিল করে আসছেন। অবৈধভাবে গ্যাস রিফিল করে বসুন্ধরা কম্পানিসহ উল্লিখিত কম্পানিগুলোর সুনাম বাজারে নষ্ট করছেন। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ সরকারকে কর ও ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। ভোক্তাদের পরিমাপে গ্যাস কম দিচ্ছে এবং স্থানীয় গ্যাস ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’
স্থানীয় সিদ্দিক মাস্টার জানান, এই গ্যাস রিফিল প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ সময়ে গোপনে রাতের বেলায় কাজ করা হয়। কাজগুলো করতে তাদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে, যারা রাতে এসব কাজের পাহারা দিয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা এলপিজি বিক্রি করে থাকে তারা রাতে একসঙ্গে অনেক খালি সিলিন্ডার নিয়ে এসে এই রিফিলিং স্টেশন থেকে ভর্তি করে নিয়ে যায়। তাদের যেন কেউ কোনো ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য সংঘবদ্ধ চক্রটি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরে পাহারা দেয়। এখান থেকে যারা গ্যাস রিফিল করে নিয়ে যায় তাদের সিলিন্ডারপ্রতি মোটা টাকা লাভ হয় বলেই রাতের অন্ধকারে ব্যবসাটি জমজমাট।
এ বিষয়ে স্যাটেলাইট এলপিজি প্লান্টের ম্যানেজার জসিম উদ্দিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি তা না ধরায় প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিনাত ফৌজিয়া বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি অবগত নই। বিষয়টি আমি এখনই জানতে পারলাম।’