সাতপাহাড়ের কোলে এক ছোট্ট গ্রাম-নাম তার ঝিকিমিকি। গাঁয়ের রাস্তা আঁকাবাঁকা, ঝোপজঙ্গল গা ছমছমে। সেখানেই থাকে দুই বোন শাহি আর রাহি। বয়সে তারা বড়জোর এক বছরের ফারাক, কিন্তু দস্যিপনায় দুজনই সমানে সমান!
শাহি একটু গম্ভীর, চিন্তাশীল। রাহি একটু ডানপিটে, চোখে তীব্র ঝিলিক। এক দিন দুপুরের ঠিক পরে হলুদের রোদে পাখির ডাকের ফাঁকে- রাহি কানে কানে বলল, দিদি, চলো না, সাতপাহাড়ের ওই ওপারে যাই! মা বলেছিল, ওখানে নাকি ভূতপুর আছে!
শাহির চোখ জ্বলে উঠল।
ভূতপুর?
হু! এক জায়গা যেখানে ভূত থাকে, পেতনিরা গান গায়, হাতি চা খায়, আর বাঘ শীত পড়লে সোয়েটার পরে!
শাহি ব্যাগে পুরে নিল এক পুরোনো টর্চ, দুই প্যাকেট বিস্কুট, এক বোতল জল, আর মায়ের আলতা দেওয়া ছড়িটা।
দুজনে হাঁটা দিল পাহাড় পেরিয়ে গহিন পথে।
পথে দেখা মিলল এক গাছ, যার পাতায় জড়ানো কাঁপা কাঁপা হাসি। দূর থেকে যেন ভেসে এলো,
হু হু হু... কে এলে রে?
শাহি আলতো করে বলল,
আমরা দিদি-বোন। ভূতপুর খুঁজতে এসেছি।
সেই সময় ঝোপ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো এক বুড়ি। চোখে তার লাল আলতা, মাথায় ঝুঁটি, আর কান থেকে ঝুলছে বেলপাতার দুল!
তোমরা ভূতপুরে যেতে চাও? আগে বলো, ভয় পাও না তো?
রাহি গলা ফাটিয়ে বলল,
ভয় তো ভূতের! আমরা তো বাঘের পিঠে চড়ি!
বুড়ি মুচকি হেসে বলল,
চলো তবে, দেখাও তোমাদের সাহস।
তারপর তারা ঢুকে পড়ল এক গুহায়। গুহা কেবল গুহা নয়-ওটা যেন এক জাদুর দরজা। ওপারে এক রঙিন বন! সেখানে-
-এক হাতি পিয়ানো বাজাচ্ছে,
-এক ভল্লুক ডান্স শিখছে এক পেতনির কাছে,
-এক ঘোড়া কবিতা পড়ছে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামক একটা ঝরনার পাশে,
-আর এক বাঘ কাঁথা মুড়ি দিয়ে ‘বুকলেট’ পড়ছে আগুনের আলোয়!
শাহি ফিসফিস করে বলল,
রাহি, এটা কি স্বপ্ন?
রাহি বলল,
স্বপ্ন হলে এমন ঘ্রাণ পাবি না! ভাল্লুকটা মধু খাচ্ছে, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি!
এমন সময় আকাশে গর্জন। কালো মেঘে ঢেকে গেল আলো। পেতনি বলল,
এই বন থেকে বেরোতে হলে তিনটি ধাঁধার উত্তর দিতে হবে!
বাঘ এসে গম্ভীর গলায় বলল-
১. আমি নেই, তাই সবাই আমায় ভয় পায়। থাকলেই চোখে কিছু দেখা যায় না। কে আমি?
২. আমাকে যত কাটো, আমি তত বড় হই। কে আমি?
৩. আমি যদি না খাই, সবাই খুশি। আমি খেতে থাকলেই ভয় পাও। কে আমি?
শাহি হাত তুলে বলল-
১. অন্ধকার,
২. গর্ত,
৩. আগুন!
ঝড় থেমে গেল। বাঘ হেসে উঠল, ভল্লুক এক তালিয়া দিল, আর পেতনি বলল-তোমরা সত্যিকারের সাহসী! এই ঘোড়াটা তোমাদের ফেরত নিয়ে যাবে।
তারা ফিরল। গ্রামে ঢোকার মুখে মা দাঁড়িয়ে। রেগে গিয়ে বললেন,
এই সন্ধ্যা অবধি কোথায় ছিলে?
রাহি বলল,
ভল্লুকের সঙ্গে পিয়ানো বাজাচ্ছিলাম।
মা চশমা নামিয়ে বললেন,
ভল্লুক আবার পিয়ানো বাজায় নাকি?
শাহি কাঁধ উঁচু করে বলল,
আর পেতনি রবীন্দ্রসংগীত শেখায়!
সেই রাতে, ঘরের জানালায় পেঁচা এসে ডেকে উঠল,
হু হু হু... আবার এসো
ভূতপুরে...