প্রাচীন বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ) বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। পাল–সেন যুগের পর বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে চাঁদ রায় ও কেদার রায় এই অঞ্চলে নেতৃত্বের দীপ্ত ছাপ রেখে গেছেন। ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ সেই বিক্রমপুরেরই স্মারক হয়ে আজও অটুট দাঁড়িয়ে আছে সিরাজদিখান উপজেলার ব্রজেরহাটি গ্রামের দৃষ্টিনন্দন প্রাচীন স্থাপনা—‘রায় সাহেবের বাড়ি’।
এই বাড়ির নির্মাতা গ্রিস চন্দ্র দাস ছিলেন একজন বৃহৎ ব্যবসায়ী। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সমাজে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে দেওয়া হয় সম্মানজনক ‘রায় সাহেব’ উপাধি। বাড়ির প্রবেশমুখে এখনো জ্বলজ্বলে সেই উপাধি খোদাই করা রয়েছে। ১৯৩৫ সালে নির্মিত এই বাড়ি সেসময়কার স্থাপত্যশৈলী এবং নির্মাতার সামাজিক মর্যাদার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ।
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সমাজসেবামূলক উদ্যোগ
নিজের ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি গ্রিস চন্দ্র দাস ছিলেন জনহিতৈষী। বাড়ির ভেতরে থাকা একটি সংরক্ষিত কক্ষ আজও সাক্ষ্য দেয় তাঁর সমাজসেবার। সে কক্ষেই একসময় পরিচালিত হত একটি ছোট ডিসপেন্সারি। ম্যালেরিয়া যখন ভয়ংকর আকার ধারণ করেছিল, তখন এখান থেকে তিনি এলাকার মানুষের জন্য কুইনাইন বিতরণের ব্যবস্থা করেন—যা সেই সময় ছিল ম্যালেরিয়ার একমাত্র কার্যকর প্রতিষেধক। তাঁর এই উদ্যোগ ছিল মানবিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ।
উত্তরাধিকার ও বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে গ্রিস চন্দ্র দাসের কোনও উত্তরাধিকারী এই বাড়িতে থাকেন না। তিনি অঞ্চল ত্যাগের পূর্বে বাড়িটি তাঁর বোনের কাছে দান করে যান। এরপর তাঁর বোনের বংশধররাই বাড়িটির দেখভাল করে আসছেন। তবে কেন তিনি তাঁর পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে চলে যান—সে তথ্য আজও অজানা।
অতীতের জৌলুস হারালেও এখনও মহিমাময়। সময়ের আবর্তে বাড়িটির আগের ঐশ্বর্য কিছুটা ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও এর নান্দনিকতা ও ঐতিহাসিক মূল্য আজও অটুট। একসময় রাতের চাঁদের আলোয় ঝলমলে এই অট্টালিকা যে মানুষকে বিস্ময়ে মুগ্ধ করত—তা কল্পনা করলেই জেগে ওঠে অতীতের সৌন্দর্য। ব্রজেরহাটি গ্রামের ‘রায় সাহেবের বাড়ি’ তাই কেবল একটি স্থাপনা নয়, বিক্রমপুরের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক জীবন্ত দলিল।
বিডি-প্রতিদিন/মাইনুল