একসময় দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলে এ ঐতিহ্যবাহী উৎসব পালিত হতো। তবে এখনও এই ঐতিহ্যবাহী ‘ভাদর কাটানি উৎসব বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে নিরবে পালন করা হচ্ছে। ভাদ্র মাসের শুরুতে গ্রামে গ্রামে শুরু হয় এই ‘ভাদর কাটানি’ উৎসব। ‘ভাদর কাটানি’র লক্ষ্যে বাবার বাড়ীতে যায় নববিবাহিতা বধূরা। শহরে এর প্রভাব কম থাকলেও গ্রামে গ্রামে পালন করা হয় এ উৎসব। তবে এ যুগে এই উৎসবে শিথিলতা এলেও মুছে যায়নি। নিরবে চলছে ‘ভাদর কাটানি’ উৎসব।
গত বছরের আশ্বিন থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত বিবাহিত মেয়েদের অনেকে বাবার বাড়ি ফিরছেন। স্বামীর মঙ্গল কামনার লক্ষ্যে ভাদ্র মাসের ১ তারিখ থেকে ৩ তারিখ পর্যন্ত স্বামীর মুখ দর্শন থেকে বিরতী থাকবেন তারা। আনুষ্ঠানিক ও লৌকিক লোকাচার রীতি মেনে তাঁরা যাচ্ছেন বাবার বাড়ি। নববধূকে বাবার বাড়ীতে নেওয়ার এই রেওয়াজটি স্থানীয়দের কাছে ভাদর কাটানী উৎসব নামে পরিচিত।
এ উৎসবের নিয়ম অনুযায়ী, ভাদ্র মাসের প্রথম দিন হতে কমপক্ষে দশ দিন পর্যন্ত স্বামীর মঙ্গল কামনায় কোনো নববধূ তার স্বামীর মুখ দর্শন করবেন না। মুখ দেখলে অমঙ্গল হবে। আধুনিক যুগে বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ভাদর কাটানির’ কোনো ব্যাখ্যা না থাকলেও এ অঞ্চলের আদি প্রথা অনুযায়ী, ভাদ্র মাসের পয়লা তারিখ থেকে শুরু হয়ে যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে এ উৎসব। যারা মনে প্রাণে বাঙ্গালি যারা বাঙ্গালির রীতিনীতি ও প্রথা মেনে চলার চেষ্টা করেন তাদের নিয়মের ভিতরেই রয়েছে ভাদর কাটানি প্রথা। তাছাড়া সাধারণত এ মাসে বিয়ের কোন আয়োজনও চোখে পড়ে না। প্রচলিত এ প্রথাটি যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে হিন্দুু-মুসলিমদের মধ্যে চলে আসছে।
দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে এবং ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিনাজপুর মালদহ এবং মুর্শিদাবাদের কোন কোন অংশে এই প্রথা আজও চালু আছে বলে জানা যায়।
নিয়ম অনুযায়ী, কনে পক্ষ শ্রাবণ মাসের দু’-একদিন বাকি থাকতেই বরপক্ষের বাড়িতে সাধ্যমতো বিভিন্ন রকমের ফল, মিষ্টি, পায়েসসহ নানা রকম পিঠা-পুলি নিয়ে যায়। বরপক্ষও সাধ্যমতো তাদের আপ্যায়ন করে। বাড়িতে কনে পক্ষের লোকজন আসায় চারদিকে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়। কোন এলাকায় এমন নিয়মও রয়েছে,ভাদ্র মাসে মামির হাতে ভাত খেতে হয়।এখনও ভাগ্নেরা মামার বাড়ি গিয়ে মামির হাতে ভাত খায়। কারণ ভাদ্র মাসে নানা ধরনের অসুখ বিসুখ লেগে থাকে। তাই বড়দের মতে, মামির হাতে ভাত খেলে বাকি ১১মাস ভালো থাকা যায়।
কাহারোলের সোহাগ জানায়, বউ গেছে তার বাপের বাড়ীতে।বৌকে বিদায় দিতে হবে কিংবা কনের বাড়ির লোকজন দলবেঁধে কন্যাকে নিতে আসবে। বাড়িতে অতিথি আসলে বাড়ির লোকজনরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে হাত মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা, গামছা তোয়ালের ব্যবস্থা তারপর খড়ম স্যান্ডেল ধুতি, লুঙ্গির ব্যবস্থা যেন পরিপূর্ণ করা হয়। তারপরে খাওয়ার জন্য ছাগল মুরগি, ডিম, দুধ, কলা, দই, চিড়া, মুড়ি, পায়েশ, পুলি, পিঠা, আয়োজনের মধ্যে সবই থাকে বাঙ্গালী সমাজে।
বীরগঞ্জের গোলাপগঞ্জ বাজারের রেজাউল ইসলাম জানায়, ভাদর কাটানি মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো ধর্মীয় বিষয় না হলেও এ অঞ্চলে প্রথাটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। একসময় সনভ্রান্ত হিন্দু সম্প্রদায় এ উৎসবকে জাকজঁমকভাবে পালন করত। তাদের এই রেওয়াজ বা রীতি বংশানুক্রমে উত্তরাঞ্চলের মানুষকে প্রভাবিত করে। এক পর্যায়ে উৎসবটি এ অঞ্চলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি সাংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায় ‘ভাদর কাটানি উৎসব’। আগে গরু গাড়ীতেই বেশী যাতায়াত করতো, যদিও এখন ভিন্ন ভিন্ন যানবাহনে চলাচল করে নববধুরা। এখন কম দেখা গেলেও মুছে যায়নি।
বিডি প্রতিদিন/এএম