চৈত্র সংক্রান্তি তিথীতে প্রায় দুইশ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে পূজা অর্চনার মধ্যে দিয়ে চড়ক পূজা ও মেলায় হাজার হাজার ভক্তদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় এ চরক পুজা ও একদিনের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সোমবার দুপুরের পর থেকে চারদিকে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে।
সবার দৃষ্টি ৩০ফুট উচ্চতার একটি কাঠের দণ্ডের দিকে। সেখানে আড়াআড়ি করে বাঁশ বেঁধে তাতে ঝোলানো লোহার বড় দুটি বড়শি। সেই বড়শি পিঠের চামড়ায় গেঁথে শূন্যে ঘুরছিলেন শ্রী শম্ভু চন্দ্র রায় (৫৫)। চৈত্র সংক্রান্তি তিথিতে দেবতাকে তুষ্ট করতে নিজেকে উৎসর্গ করেন তিনি। তিনি ১৭ বছর ধরে চড়ক পূজার সন্ন্যাসী হয়ে দেবতাকে খুশি করার চেষ্টা করছেন। শুন্যে ঘোরার সময় তিনি ফুল-জল, আবির, কলা, বাতাসা, নকুলদানা ইত্যাদি ছিটিয়ে দিচ্ছেন ভক্ত-দর্শকের দিকে। দর্শনার্থীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন তা সংগ্রহ করার জন্য। এসময় চলছিল উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি। বাজছিল ঢাকঢোল।
সোমবার দিবাগত সন্ধার দিকে চৈত্র সংক্রান্ত উপলক্ষে দিনাজপুরের সদরের সুখসাগরের পূর্বপারে বিদ্যাস্বরি এলাকায় এই চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মহাদেব খুশি হলেই নতুন বছরে সুখ-শান্তিতে ভরে উঠবে সংসার- এই বিশ্বাস সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বীদের।
এছাড়াও একই সময়ে সদরের শেখপুরা ইউপির উত্তর গোপালপুর শীব দূর্গা মন্দির কমিটির আয়োজনে এই ঐতিহ্যবাহী চরক পূজা ও মেলা, সদরের কমলপুর, চিরিরবন্দরসহ বিভিন্ন স্থানে চরক পুজা অনুষ্ঠিত হয়।
এসময় একজন ভক্তের পিঠে বড়শি গেথে চড়ক ঘোরানো হয়। হাজার হাজার নরনারী ভক্তদের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে উঠে মেলা প্রাঙ্গন। স্থানীয় ভক্তদের আর্থিক অনুদানে এই পূজা অর্চনা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বলে জানায় আয়োজকরা। চড়ক পূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মন্দিরে কয়েকদিন ধরে হরগৌরী নৃত্য, অসিনৃত্য, শিবের গাজন করা হয়।
প্রধান মাহান সাগর রায় বলেন, মহাদেব ঠাকুরের পূজা ও আরাধনা করা হয়। প্রতিবছরই এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পুজারী ভক্ত নারদ মনি বলেন, মা শীতলা ও বুড়ি মাতাকে সন্তোষ্ট করতে মূলত চরক পূজা করা হয়। পিঠে বরশী গেঁথে চরকের মাধ্যমে চরকি ঘুরিয়ে সকল সাম্প্রদায়িক-অধর্মের বিনাশ, অসত্যকে বিতারিত করে শান্তির সনাতনী বার্তা প্রতিষ্ঠিত করাই হচ্ছে চরক পূজার পবিত্র মাহাত্ব্য।
চরক পূজাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের দোকান পাট বসে যা মেলায় রুপান্তর হয়। এছাড়া অনেকের মনোবাসনা ও ভক্তি সহকারে মা শীতলা ও বুড়ি মাতার কাছে মানত করে ফল পায়।
দর্শনার্থী বাপ্পী মহাদেব দাস জানান, প্রতিবছর এখানে চড়ক ঘোরানো হয়। সনাতন ধর্মের মানুষেরা পুণ্যের আশায় এ চড়ক পূজার আয়োজন করে থাকেন।
প্রধান মাহান সাগর রায় নামে আরেক দর্শনার্থী বলেন, মহাদেব ঠাকুরের পূজা ও আরাধনা করা হয়। প্রতিবছরই এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
আরাধনা রায় নামে একজন দর্শক বলেন, আমার কোনো সন্তান নেই। শুনেছি এ কলা খেলে সন্তন লাভ করা যায়। অনেক কষ্টে একটি কলা পেয়েছি। আমি ও আমার স্বামী সন্তানের আশায় কলাটি ভগবানের নামে খাবো।
শম্ভু চন্দ্র রায়ের বলেন, এ নিয়ে ১৭-১৮ বার চড়ক হিসেবে ঘুরেছি। আমি সুস্থ আছি। কোনো দিনই কোনো সমস্যা হয়নি। পুণ্য লাভের আশায় এ কষ্ট করি।
আয়োজকদের একজন দুলাল চন্দ্র রায় বলেন, রাজাদের আমল থেকে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ছোটবেলা থেকে এ চড়ক ঘোরানো দেখে আসছি। আমার দাদা, আমার পিতার পর আমিও এ আয়োজনের সঙ্গে জড়িত।
বিডি প্রতিদিন/এএম