জীবনের গল্প অর্থাৎ পারিবারিক গল্পবিহীন চলচ্চিত্রের সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কোনো মিল নেই। এগুলো হলো হাওয়াই মিঠাইর মতো। যতক্ষণ মুখে থাকে ততক্ষণ মিষ্টি লাগে। তারপর সব মজা শেষ। এমন চলচ্চিত্রকে বলা হয় মাসালাদার চলচ্চিত্র। যা নির্মাণ করা হয় কমার্শিয়াল চিন্তাভাবনার আদলে। এতে শিল্পের কোনো ছোঁয়া থাকে না। অথচ চলচ্চিত্র হলো একটি শিল্প। এক শ্রেণির দর্শক সিনেমা হলে শিস বাজাতে ও অন্যরকম সুড়সুড়ি পেতে এসব অ্যাকশন ঘরানার জীবনের গল্পবিহীন চলচ্চিত্র দেখে থাকে সস্তা বিনোদন লাভের আশায়। এদের বিকৃত রুচির দর্শকও বলা হয়ে থাকে। আসলে ‘চলচ্চিত্র’ শব্দের অর্থ হলো চলমান জীবনের চিত্র। তাই একটি চলচ্চিত্রের গল্প গড়ে উঠবে মানুষের জীবনের পারিপার্শ্বিক ছায়াকে ঘিরে। একসময় বিশেষ করে আশির দশক পর্যন্ত এ দেশে জীবনঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাণ হতো বলে সেগুলো কালজয়ী হয়ে আছে। যেমন- অবুঝ মন, অশ্রু দিয়ে লেখা, নয়ন মনি, গোলাপী এখন ট্রেনে, ভাত দে, শুভদা, আবির্ভাব, স্বামী-স্ত্রী, সত্য-মিথ্যা, আমি সেই মেয়ে, নীল আকাশের নীচে, আলোর মিছিল, ওরা ১১ জন, ছুটির ঘণ্টা, অশিক্ষিত, সুন্দরী, এখনই সময়, ঘর সংসার, বৌরাণী, ঘুড্ডি, কসাই, অনন্ত প্রেম, অন্তরে অন্তরে, সত্যের মৃত্যু নেই, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, সবুজ সাথী, জীবন থেকে নেয়া, সীমানা পেরিয়ে, নাচের পুতুল, লক্ষ্মীর সংসার, সারেং বৌ, বসুন্ধরা, ডুমুরের ফুল, ডানপিঠে ছেলে, সূর্যদীঘল বাড়ি, স্বরলিপি, লাল কাজল, পুরস্কার, হাজার বছর ধরে, মোল্লাবাড়ীর বৌ-সহ অসংখ্য জীবন গল্পের চলচ্চিত্র। আর এসব চলচ্চিত্রের গল্প লিখতেন জহির রায়হান, আহমদ জামান চৌধুরী, খান আতাউর রহমান, আমজাদ হোসেন, আশীষ কুমার লৌহ, রফিকুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, ছটকু আহমেদ, আলমগীর কবির, সুভাষ দত্ত, ফতেহ লোহানী, আজিজুর রহমান, মতিন রহমান প্রমুখ। এদের মধ্যে অনেকে চলচ্চিত্রের জন্য শ্রুতিমধুর গানও রচনা করে গেছেন।
নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে দুঃখজনকভাবে এ দেশের চলচ্চিত্রে অশনি সংকেত দেখা দেয়। চলচ্চিত্র জগতে অনুপ্রবেশ করে মাফিয়া চক্র। এরা ছিল কোনো বিদেশি চলচ্চিত্র জগতের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী দুর্বৃত্তের দল। তারা বাংলাদেশের প্রধান গণমাধ্যম চলচ্চিত্র শিল্পকে ধ্বংসের নীলনকশায় মেতে ওঠে। কারণ একটি চলচ্চিত্র দেশ, জাতি, সমাজ ও পরিবারের জন্য কল্যাণকর বাণী বহন করে। এসব চলচ্চিত্র দেখে মানুষ তার জীবন গড়ার প্রেরণা লাভ করে। এ কারণেই নব্বই দশকের শেষভাগে মাফিয়া চক্র শুরু করে পাইরেসি, নকল আর অশ্লীল চলচ্চিত্রের মহোৎসব। ফলে সুস্থ রুচির দর্শক বিশেষ করে মহিলারা সিনেমা হল বিমুখ হতে শুরু করে। দর্শকের অভাবে প্রায় ১ হাজার ৪০০ সিনেমা হলের সংখ্যা এখন অর্ধশতের ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। নামিদামি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্বৃত্তরা প্রথমেই দুটি অপকর্ম দিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রের বিনাশের কাজ শুরু করে। প্রথমে ভালো মানের চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেই তা পাইরেসি করা দ্বিতীয়ত, বাইরের দেশের আজগুবি গল্পের চলচ্চিত্রের নকল করে এখানে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা। তারা তামিল তেলেগু ছবি এনে এর ভাষা সুইপারদের দিয়ে বাংলায় অনুবাদ করিয়ে নিত। ওই সময় দুর্বৃত্তরা তাদের সৃষ্ট কিছু বিকৃত রুচির মানুষকে চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক বানিয়ে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করিয়ে দেয়। সঙ্গে একদল বিকৃত রুচির শিল্পীও তৈরি করে তারা। এফডিসির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় এসব মাফিয়ার দখলে। এদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে এফডিসি ও চলচ্চিত্র জগৎ ছাড়তে বাধ্য হয় সিনিয়র নির্মাতা ও শিল্পীরা। এই সুযোগে সিনেমা হল ও এফডিসিকে রীতিমতো পতিতালয় বানিয়ে ছাড়ে তারা। অসামাজিক কার্যকলাপের আখড়া হয়ে যায় এফডিসি। এভাবে নকল ছবি পাইরেসি আর অশ্লীল ছবি দিয়ে বাংলাদেশের সুস্থ চলচ্চিত্রের কফিনে পেরেক ঠুকে দেয় নীলনকশা বাস্তবায়নকারীরা। যার জের টানতে হচ্ছে এখনো। গত দেড় দশক ধরে সিনেমা হল প্রায় দর্শক শূন্য।
শুধু বছরের দুই ঈদে কয়েকটি চলচ্চিত্র দেখতে দর্শক সিনেমা হলে যায় সত্যি; কিন্তু এসব চলচ্চিত্র চিরদিনের মতো দর্শক হৃদয়ে আর গেঁথে যায় না। ঈদে সিনেমা হলে দর্শক যাওয়াটা আসলে মনে-প্রাণে ছবি দেখার জন্য যাওয়া নয়, উৎসবের দিনে বিনোদনের অন্যান্য অনুষঙ্গ যেমন- মেলা, চিড়িয়াখানা ইত্যাদিতে যাওয়ার পর আরও বিনোদনের স্থান পেতে সিনেমা হলে যায়। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, যেসব দর্শক ঈদের ছবি দেখতে যায় তারা কী সব বিত্তের। বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্র মারপিট, আইটেম গান, মাদক গ্রহণ, রক্তারক্তি, অশ্লীল পোশাক আর সংলাপে বিকৃত রুচির বিনোদন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানে জীবনের সঙ্গে এসব চলচ্চিত্রের কোনো যোগাযোগ নেই। মাঝে মধ্যে ভিন্নধারার হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। কিন্তু চুন খেয়ে জিভ পোড়ানো দর্শক পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এসব চলচ্চিত্র দেখতেও আর সিনেমা হলমুখী হয় না।
এখন এ দেশের দর্শক আর চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের একটিই প্রশ্ন- ‘এ দেশের চলচ্চিত্রের সুদিন কবে ফিরবে’। চলচ্চিত্র সাংবাদিক আর গবেষক অনুপম হায়াতের কাছে এই প্রশ্ন রাখতেই তিনি অনেকটা বিরক্তির সুরে কপাল কুঁচকে বলেন, ‘আমি জানি না’।