‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি দিও খামে’– কবি মহাদেব সাহার ‘চিঠি দিও’ কবিতার এই লাইনগুলোই বলে দেয় প্রিয়জনের একটি চিঠির জন্য কতটা ব্যাকুল থাকত মানুষ।
প্রিয়জনকে চিঠি পাঠিয়ে মানুষ উত্তরের জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করত, কখন আসবে ডাক পিয়ন। আত্মীস্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে চিঠিপত্র পাঠাতে ব্যবহৃত হতো এ মাধ্যমটি। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে তথ্য প্রযুক্তির নতুন সব মাধ্যমের কারণে এক প্রকার অচল হয়ে পরে আছে ডাক বিভাগের এ সব ডাকবাক্স। ব্যবহার না হওয়ার কারণে এগুলোর বর্তমান অবস্থা বেহাল। গুরত্ব কমে গেলেও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের চিঠি আদান-প্রদান, চাকরির আবেদন, সঞ্চয়পত্র লেনদেনসহ বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ কাজের জন্য এখনও ডাকঘরে যেতে হয়। তবে কর্তাব্যক্তিদের উদাসীনতার কারণে ডাক বিভাগের সেবাবঞ্চিত হচ্ছে মানুষ।
সারা দেশের মতো এমন অবস্থা ফেনীতেও দেখা যায়। আর এই সুযোগে কুরিয়ার ব্যবসার পালে হাওয়া লেগেছে। স্থানীয়রা বলছেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডাক বিভাগকেও আধুনিকায়ন করতে হবে। তবে সংশ্লিষ্টরা দেখিয়েছেন জনবল সংকটের অজুহাত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফেনী জেলার প্রধান ডাকঘরের অধীনে ছয় উপজেলায় ছয়টি ডাকঘর, ইউনিয়ন পর্যায়ে ৩৭টি ডাকঘর ও ১৯টি উপ-ডাকঘর রয়েছে। এগুলোতে এখন শুধু দাপ্তরিক চিঠির আদান-প্রদান আর মানি অর্ডার করা হয়। এ ছাড়া দেশের মধ্যে পার্সেল আনা-নেওয়া ও প্রবাসীরা দেশের বাইরে ডকুমেন্ট পাঠিয়ে থাকেন।
ফেনীর প্রধান ডাকঘরের পোস্ট মাস্টার তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আগে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ব্যক্তিগত চিঠির আদান-প্রদান হলেও এখন শুধু সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের চিঠি আসে। মানুষ আধুনিক হতে হতে চিঠি-ডাকবাক্স থেকে দূরে সরে গেছে। অযত্নে ডাকবাক্সগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় বাক্সগুলো ভেঙে পড়ে আছে। সরকার বিভিন্ন সময় ডাক বিভাগকে আধুনিক করার উদ্যোগ নেয়। তবে জনবল সংকটের কারণে আমরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উঠতে পারি না।’
বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে ডাকবাক্স আর চিঠির পরিচয় নেই জানিয়ে ফেনীর সাবেক কৃষি কর্মকর্তা মো. হামিদুল্লাহ বলেন, ‘ছাত্র অবস্থায় অনেক চিঠি লিখেছি। যোগাযোগ, গুরুত্বপূর্ণ নথি ও টাকা আদান-প্রদানের একমাত্র মাধ্যম ছিল পোস্ট অফিস। ছাত্রজীবনে নোয়াখালীতে পড়াশোনার সময় চট্টগ্রাম থেকে বাবা খরচের টাকা মানি অর্ডার করতেন। ওই টাকার জন্য পোস্ট অফিসে গিয়ে বসে থাকতাম। মানি অর্ডারের খামের ওপর বাবা ছোট করে কোনো বার্তা লিখে দিতেন। সে অনুভূতি এখনকার প্রজন্ম বুঝবে না। এখন তো কেউ চিঠিই লেখেন না। সবাই প্রযুক্তিনির্ভর।’
মো. ইলিয়াস নামে এক প্রবাসী বলেন, ‘২০ বছর আগেও মানুষ চিঠি লিখত। দেশে কিংবা প্রবাসে প্রিয়জনদের খবরাখবর জানার মাধ্যম ছিল চিঠি। প্রবাস থেকে যখন মা বাবাকে চিঠি লিখতাম তার প্রতিউত্তরে চিঠি পাওয়ার অপেক্ষায় ঘুম আসত না। কিন্তু মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট আসার পর চিঠির কদর কমে গেছে।’
মিষ্টি চৌধুরী নামে ফেনী শহরের এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘সরকারের অন্যান্য দপ্তরের তুলনায় ডাক বিভাগ অনেক পিছিয়ে আছে। এ দপ্তরকে প্রযুক্তিনির্ভর করে সাজাতে হবে। চিঠি আদান-প্রদান ছাড়াও পোস্ট অফিসে আরও অনেক সেবা দেওয়া হয়। এ সেবাগুলো পেতে গিয়ে মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন।’
শহরের টেকনিক্যাল এলাকার বাসিন্দা ইব্রাহিম হক বলেন, ‘ডাকবাক্সে চিঠি ছাড়া হোক বা না হোক, বাক্সগুলো যদি সংরক্ষণে রাখা যায় তাহলে আমরা ঐতিহ্য হিসেবে এটি তুলে ধরতে পারব।’
জসিম ফরায়েজী নামে ফেনীর এক গণমাধ্যমকর্মী বলেন, ‘ডাক বিভাগকে মানুষের দোরগোড়ায় নিতে সংশ্লিষ্টদের এখনই ভাবতে হবে। শুধু প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে বসে থাকলে টরে-টক্কার সেই টেলিগ্রাফ যন্ত্রের (তারবার্তা) মতো স্মৃতির জাদুঘরে স্থান হবে ডাকবাক্সের। নতুন প্রজন্ম জানবেই না ডাকবাক্স বলতে কিছু একটা আমাদের ছিল।’
ফেনী সদর উপজেলার শর্শদি ইউনিয়নের শাখা ডাকঘরের ইডি (জরুরি ডাক সরবরাহকারী) আবু তাহের ভূঁইয়া বলেন, একসময় আমাদের এলাকায় দৈনিক ১০০-১২০টি সাধারণ চিঠি ও ১৮-২০টি রেজিস্ট্রি চিঠি আসত। কিন্তু বর্তমানে মাসে গড়ে ৩০-৪০টি চিঠি আসে।
জনবল সংকটের কারণে পূর্ণাঙ্গ সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন জানিয়ে ফেনী ডাকঘরের পোস্টমাস্টার তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার দপ্তরে ৮১টি পদের বিপরীতে জনবল আছেন ৩৪ জন। ৯ জন ডাকপিয়ন থাকার কথা, আছেন তিনজন। লোকবল কম থাকায় চাইলেও আমরা কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারি না। তারপরও আমরা সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
ডাকবাক্স সংরক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যবহার না থাকায় অনেক ডাকবাক্স এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। এরপরও যেগুলো আছে সেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল