দীর্ঘ চার মাস যুক্তরাজ্যে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরলেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। লাখো মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অভ্যর্থনায় সিক্ত হয়ে গতকাল বেলা ১টা ২৫ মিনিটে তিনি গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’য় পৌঁছান।
সাড়ে তিন বছর পর তিনি গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে ঘরে প্রবেশ করেন। তাঁর সঙ্গে দেশে ফেরেন দুই পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামিলা রহমান। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাঁকে বহনকারী কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দর থেকে খালেদা জিয়া সরাসরি তাঁর গুলশান-২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের বাসভবন ফিরোজায় আসেন। এ সময় পথে পথে জনস্রোতের ফুলেল অভ্যর্থনায় সিক্ত হন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া। প্রিয় নেত্রীকে স্বাগত জানাতে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা উষ্ণ শুভেচ্ছা ও অভ্যর্থনা জানান দলীয়প্রধানকে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে বিজিবি, পুলিশ বাহিনী, র্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সমন্বিতভাবে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেন। দেশনেত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার নেতা-কর্মী সুশৃঙ্খলভাবে সমবেত হন। তাঁরা বেগম জিয়ার গাড়ির ওপর ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে উষ্ণ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। বিমানবন্দরে নেত্রীকে শুভেচ্ছা জানানোর পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, তাঁর আগমন দেশকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ সহজ করবে।
খালেদা জিয়ার আগমন উপলক্ষে সকাল থেকে গুলশানে ফিরোজাসংলগ্ন এলাকায় ভিড় করেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। তাঁদের হাতে ছিল জাতীয় ও দলীয় পতাকা। এ ছাড়া ব্যানার-ফেস্টুন। তাঁরা স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে তোলেন পুরো এলাকা। গুলশান-২ নম্বর গোল চত্বর এলাকায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ ও বিএনপি নেতা মোস্তাফিজুর রহমান বাবুলের নেতৃত্বে কয়েক শ নেতা-কর্মী নেত্রীকে শুভেচ্ছা ও অভ্যর্থনা জানান। এ সময় দলের গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম ও সহ-তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক এইচ এম সাইফ আলী খান উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতারা তাঁদের জন্য নির্ধারিত বিভিন্ন স্থানে দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়ে অবস্থান করেন।
ফিরোজা ও এর আশপাশের এলাকায় আগে থেকেই ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ফিরোজার প্রবেশপথ গুলশান-২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের সামনে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। সড়কটির দুই পাশে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবনের সামনে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এস এম ওবায়দুল হক নাসিরের নেতৃত্বে একটি টিম শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করে। টিম সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ফজলুর রহমান খোকন, ইকবাল হোসেন শ্যামল, কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাইফ মাহমুদ জুয়েল, গোলাম মাওলা শাহীন, মোস্তফা জগলুল পাশা পাপেল, করিম সরকার, দুলাল হোসেন, মিজানুর রহমান রাজ, আরাফাত রাব্বি, শিমুল আহমেদ, আবুল হাসান, রফিকুল ইসলাম রাসেল ও আজমল হক পাইলট।
ফিরোজার সামনে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। পাশাপাশি ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্সের (সিএসএফ) সদস্যরা। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা উপলক্ষে তাঁর গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’ আগেই সম্পূর্ণ প্রস্তুত করা হয়। পাশাপাশি নিরাপত্তাব্যবস্থাও জোরদার করা হয়।
উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৮ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাঁর লন্ডনে যাওয়ার জন্য কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বিশেষায়িত এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠান। লন্ডন পৌঁছানোর পর হিথরো বিমানবন্দর থেকে সরাসরি দ্য লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয় তাঁকে। এই হাসপাতালে টানা ১৮ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ২৫ জানুয়ারি তিনি হাসপাতাল থেকে লন্ডনে তাঁর বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় যান। সেই বাসায় থেকেই তিনি চিকিৎসা নেন।
সোমবার তাঁকে বহনকারী কাতারের রাজপরিবারের বিশেষ উড়োজাহাজটি (এয়ার অ্যাম্বুলেন্স) বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে খালেদা জিয়াকে নিয়ে দেশের উদ্দেশে রওনা দেয়। পথে কাতারের রাজধানী দোহায় যাত্রাবিরতি করে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি।
খালেদা জিয়া অনেকটা সুস্থ, মানসিকভাবেও ‘স্ট্যাবল’- ডা. জাহিদ হোসেন : লন্ডনে চিকিৎসা নেওয়ার পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। গতকাল দুপুরে ফিরোজার সামনে দেওয়া ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার পর ম্যাডাম এখন অনেকটাই সুস্থ আছেন এবং মানসিকভাবেও উনি স্ট্যাবল (শক্ত) আছেন। যদিও দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টার ভ্রমণের কারণে তিনি কিছুটা অবসন্ন। আমরা তাঁর জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।’
বিএনপি চেয়ারপারসন দেশবাসীকে শুভেচ্ছা, সালাম ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বলে জানান ডা. জাহিদ হোসেন। তাঁর জন্য কাতারের আমিরের পক্ষ থেকে বিনা খরচে বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দেওয়ায় দেশটির সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, কাতার সরকার সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে এটি দিয়েছে। এ সহায়তার মধ্য দিয়ে জিয়া পরিবারের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক, তার প্রকাশ ঘটিয়েছে। বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব সংস্থাকে সমন্বিতভাবে নিরাপত্তা দেওয়ায় বেগম জিয়ার পক্ষ থেকে তিনি ধন্যবাদ জানান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ডা. জুবাইদা রহমান ফিরেছেন, তারেক রহমানও ফিরবেন। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়। কিছুদিন পর ডা. জুবাইদা রহমান আবারও লন্ডনে যাবেন এবং দ্রুতই তারেক রহমান, তাঁর কন্যাসহ দেশে ফিরে আসবেন।
বাসভবনের সামনে ভিড় না করার অনুরোধ : এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবনের সামনে ভিড় না করতে নেতা-কর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখন কিছুটা অসুস্থ। এত লম্বা জার্নির পর চিকিৎসকেরা তাঁকে কমপক্ষে আট ঘণ্টা সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তাই কেউ এখানে স্লোগান দেবেন না, ভিড় করবেন না। দয়া করে আপনারা সবাই এখন যাঁর যাঁর বাড়িতে ফিরে যান।
ফুল, ব্যানার, পতাকা, স্লোগানে খালেদা জিয়াকে পথে পথে শুভেচ্ছা : কেউ হাতে ফুল, কেউ ব্যানার-প্ল্যাকার্ড, কেউ বা খালেদা জিয়ার ছবিসংবলিত টি-শার্ট পরে আছেন। ‘খালেদা জিয়ার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘খালেদা, জিয়া’, ‘তারেক, রহমান’, ‘খালেদা জিয়া ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ নানা স্লোগান দেন নেতা-কর্মীরা।
সকাল সাড়ে ১০টার পর বিএনপি চেয়ারপারসনকে বহনকারী উড়োজাহাজটি বিমানবন্দরে অবতরণ করলেও বেলা ১১টা ২০ মিনিটে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর বিমানবন্দর থেকে বের হয়। এ সময় নেতা-কর্মীরা পতাকা নেড়ে দলীয়প্রধানকে শুভেচ্ছা জানান।
স্বাগত জানাতে আসা নেতা-কর্মীদের হাতে ছিল বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও বিএনপির দলীয় পতাকা। বিএনপির নেতারা বলেছেন, খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে যেভাবে নেতা-কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমেছেন, তা দলের প্রতি তাঁদের আস্থার প্রমাণ।
বিএনপি এবং দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কে কোথায় অবস্থান নিয়ে খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানাবেন, তা আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের সড়কে ভিড় না করে ফুটপাতে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। যাতে যানজট বা বিশৃঙ্খলা না হয়, সে জন্য পুরো পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন।
এর আগে বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালে বিএনপি চেয়ারপারসনকে স্বাগত জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সেলিমা রহমান।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর দুই পুত্রবধূ তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমান ও মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান ছাড়াও আরও আসেন খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদার, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য এনামুল হক চৌধুরী, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল, লন্ডন বিএনপির সভাপতি এম এ মালেকসহ ১৫ জন।
চিকিৎসাধীন মাকে দেখতে হাসপাতালে যান ডা. জুবাইদা : ১৭ বছর পর গতকাল বাংলাদেশে পা রাখলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান। দেশে ফিরেই তাঁর প্রথম গন্তব্য ছিল রাজধানীর পান্থপথে স্কয়ার হাসপাতাল, যেখানে তাঁর মমতাময়ী মা, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু চিকিৎসাধীন। সাবেক নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মরহুম মাহবুব আলী খানের স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানান শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তিনি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করেন সুরভী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে। এজন্য তিনি স্বাধীনতা পদক পান। ডা. জুবাইদা রহমান অসুস্থ মাকে দেখে হাসপাতাল থেকে ধানমন্ডির পৈতৃক বাসভবন মাহবুব ভবনে যান।