সাজা পরোয়ানা গায়েব করে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সামছুল ইসলাম ওরফে শিপু। মামলার এজাহারে বাবার নামের ভুলকে পুঁজি করে আদালতের পরোয়ানাই গায়েব করে ফেলেন তিনি। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। তাকে গ্রেপ্তার হতে হয়। তবে গ্রেপ্তারের পর তথ্য গোপন করে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে আবারও পালিয়ে যান। জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চলতি বছরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ডেনমার্ক থেকে দেশে ফিরেন তিনি।
২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জ থানার একটি পরোয়ানায় র্যাব-২-এর একটি দল রাজধানীর শাহজাহানপুর থেকে শিপুকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে সোপর্দ করা হয়।
আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির পরোয়ানা হারিয়ে গেলে সাজা অনেকটা মওকুফ হয়ে যায়। কারণ বিভিন্ন আদালতে এই সাজা পরোয়ানার কোনো আলাদা রেজিস্ট্রার লিপিবদ্ধ করা হয় না। অর্থাৎ কোনো প্রসেস রেজিস্ট্রার রাখা হয় না। আদালত থেকে কোনো পরোয়ানা যদি থানায় না যায়, তাহলে থানা পুলিশ ওই আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারে না। এভাবেই সাজা পরোয়ানাকে গায়েব করার সুযোগ পান সামছুল ইসলাম।
মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে সামছুল ইসলামের পিতার নাম দেওয়া হয় আমিরুল ইসলাম। স্থায়ী ঠিকানা দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার মাছুমাবাদ গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করা হয়- ২৬ নম্বর ধানমন্ডির ১৪/এ নম্বর রোড।
তবে প্রকৃত তথ্য হলো, সামছুলের পিতা আমিরুল ইসলাম নয়, মনিরুল ইসলাম। আদালতের এক আদেশে ২০০৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর অধিকতর তদন্তের জন্য মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হয়। সংস্থাটির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার ইসমাঈল হোসেন ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিট নম্বর-৯৯। ইসমাঈল হোসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে ২০১৪ সালে সিআইডি থেকে অবসরে যান।
সামছুল ইসলামের সাজা পরোয়ানা বিষয়ে খোঁজ নিতে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এ যোগাযোগ করা হয়। সেখানে কর্মরত জালাল চৌধুরী পুরোনো একটি রেজিস্ট্রার খাতা বের করে জানান যে, ওই মামলার রায় অনেক আগেই হয়ে গেছে। মামলায় কার কার সাজা হয়েছে তা উল্লেখ আছে। রেজিস্ট্রারেও সামছুল ইসলামের বাবা আমিরুল ইসলাম লেখা রয়েছে।
এই সাজা পরোয়ানার খোঁজ পেতে যোগাযোগ করা হয় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায়। সেখানে অনেক ফাইলপত্র ঘেটে সামছুল ইসলামের নামে থাকা একটি সাজা পরোয়ানার কপি পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন সেটি থানার তৎকালীন এসআই কাজী ফেরদৌস এবং এএসআই নাসিমের কাছে পড়ে ছিল। এরপর সেটি ২০২২ সালের অক্টোবরে তামিল হয়। জানতে চাইলে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিয়াকত আলী বলেন, সামছুল ইসলামের ওই পরোয়ানিটি আর পেইন্ডিং নেই।
ওই থানার এক কনস্টেবল এ প্রতিবেদককে জানান, সামছুল ইসলামের নামে আরও সাজা পরোয়ানা ছিল। ওই আসামির কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা খেয়ে তৎকালীন ওসি এ এফ এম সায়েদ এবং পুলিশ সুপার (এসপি) গোলাম মোস্তফা রাসেল ভুল তথ্যের কথা বলে সেগুলো ফেরত পাঠিয়ে দেয়। একই সঙ্গে সামছুল ছিলেন ডেনমার্কের নাগরিক। সেই তথ্যটিও আদালতে সোপর্দ করার সময় গোপন রাখা হয়, যাতে তিনি ফাঁকফোকর বের করে দ্রুত জামিন নিয়ে চলে যেতে পারেন। আর ধরা পড়ার এক মাসের মধ্যে জামিন নিয়েই দেশ ছাড়েন সামছুল এবং তাকে থানা পুলিশের মাধ্যমেই বিমানবন্দরে পৌঁছানো হয়। সব আয়োজন করেন তৎকালীন ওসি সায়েদ। ঢাকার আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৪৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি পরোয়ানায় গত বছরের নভেম্বরে ওসি সায়েদকে কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় করা একটি মামলারও সাজা পরোয়ানা ছিল সামছুলের নামে। এটি সে সময় রূপগঞ্জ থানায় রাখা হয়নি। তবে তারা রেখেছিলেন ত্রিশাল থানায় করা অস্ত্র আইনে হওয়া সাজা পরোয়ানাটি। এখানে সামছুল ইসলামের পিতার নাম মনিরুল ইসলাম উল্লেখ করা ছিল। আদালত থেকে দেওয়া নম্বর দেওয়া হয়েছে ০৫/০৯। আর সাজার পরিমাণ ছিল ৭ বছর। এই মামলার রায় হয় ২০১০ সালে। ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় করা মামলার সাজা পরোয়ানাটি এখনো তামিল হয়নি বলে জানায় আদালত সূত্র।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সামছুল ইসলামের বাড়ির কেয়ারটেকার আল-আমিন বলেন, সামছুল ইসলাম শিপু এখন দেশে আছেন। গ্রেপ্তারের পর জামিন নিয়ে কীভাবে দেশ ছাড়েন সে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি।
ঢাকা জর্জ কোর্টের আইনজীবী সুমন মৃধা বলেন, সাজা পরোয়ানার বিষয়টি তদারকির জন্য রেজিস্ট্রার মেইনটেইন করা দরকার। আর রায় হলে যে থানায় মামলা হয় সেখানে মামলার ফল জানাতে একটি কপি পাঠানো দরকার। কোন কোন পরোয়ানার আসামি পাওয়া গেল, আর কোনটার পাওয়া গেল না, এগুলো লিপিবদ্ধ থাকা দরকার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর শাহজাহানপুরের ভারটেক্স টাওয়ারে দ্বিতীয় এবং নবম তলায় দুটি ফ্ল্যাট আছে সামছুল ইসলামের। সম্প্রতি তিনি এগুলো বিক্রির নোটিস টানিয়েছেন। কিন্তু রূপগঞ্জের মাছুমাবাদ গ্রামের দীঘিরপাড়ে গিয়ে সামছুল ইসলামের কোনো বাড়ি পাওয়া যায়নি। তবে সেখানে কাজী জহিরুল আলম নামে ৭০ বছর বয়সি একজন বলেন, সামছুল ইসলামের নাম কাজী সামছুল ইসলাম। তার বাবা কাজী মনিরুল ইসলাম। তারা ঢাকায় থাকেন। গ্রামে তারা আসেন না। আগে ধানমন্ডি এলাকায় থাকতেন। পরে শাহজাহানপুরে কাজী ভিলা নামে একটি বাড়ি করে। পরে সেটি ভারটেক্স নামে বহুতল ভবন করে। তিনি শুনেছেন সামছুলসহ তার ভাইবোনেরা সুইজারল্যান্ডে থাকে। আর মাছুমাবাদ গ্রামের পোড়াব এলাকায় তাদের পৈতৃক কাজী বাড়িতে তাদের চাচাতো ভাই কাজী সিরাজুল ইসলাম থাকেন। সামছুল আগে সুইডেনে থাকতেন।
কী ঘটেছিল সেদিন : ময়মনসিংহে পূরবী সিনেমা হলের সামনে ফ্রিডমপার্টির অফিসের কাছে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ সময় ফ্রিডমপার্টির সদস্যদের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে হারুন অর রশিদ নামে এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় ১৯৯০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন হারুনের দুলাভাই মোশারফ হোসেন বাবলু।
মামলা নম্বর-১৭। এই মামলার ৯ নম্বর আসামি সামছুল ইসলাম। দীর্ঘ ১৯ বছর পর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এ মামলাটির বিচার শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৯ মে মামলার রায় হয়।