কক্সবাজারে মানব পাচার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী উভয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গোয়েন্দা সূত্রমতে, মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের যোগসাজশে অপহরণ, মুক্তিপণ ও এর সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক রয়েছে উখিয়া ও টেকনাফে। স্থানীয়দের পাশাপাশি তারা বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শিশু, নারী ও পুরুষ পাচারের জন্য সংগ্রহ করে। সুযোগ বুঝে ট্রলারে তুলে দেওয়া হয় তাদের। এর মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো দালালরা তাদের আটকে মুক্তিপণ আদায় করে।
২০২৪ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৮৬টি মানব পাচারের ঘটনা নিয়ে কাজ (তদন্ত) করেছে ‘অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং ওয়ার্কিং গ্রুপ।’ এসব ঘটনার বেশির ভাগ রোহিঙ্গা জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত। তদন্তে উঠে এসেছে ভুক্তভোগীদের প্রলোভন দেখিয়ে কর্মসংস্থান ও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সহায়তা হ্রাস ও খাদ্যসংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে, ফলে তাদের আর্থিক অসহায়ত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে পাচারকারীরা রোহিঙ্গা ও স্থানীয় ভুক্তভোগীদের বিদেশে চাকরি, বিয়ের প্রস্তাব কিংবা নিরাপদ অভিবাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রলোভিত করছেন। পরবর্তীতে তাদের জবরদস্তিমূলক শ্রম ও যৌন শোষণ করা হচ্ছে।
২০১৮ সাল থেকে আইওএমের সহযোগিতায় কক্সবাজার জেলার টেকনাফ (দুটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ) ও মহেশখালী উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে মানব পাচার প্রতিরোধে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পের কর্ম এলাকায় বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনার মাধ্যমে সংস্থাটি গণ্যমান্য ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে মানব পাচার প্রতিরোধে সক্রিয় এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। এরপরও থামেনি মানব পাচার।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ক্যাম্প পর্যায়ে ৫৭৪টি এবং টেকনাফ, মহেশখালী সদর, উখিয়ায় ৮৩০ জনসহ মোট ১ হাজার ৪০৪ জন পাচারের শিকার ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর সমুদ্রপথে মানব পাচারকালে ১৫০টিরও বেশি ঘটনায় ৬৫৭ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা নিখোঁজ বা মারা গেছেন। এসব ঘটনায় জেলার আদালতসমূহে ৪৬০টি মানব পাচার মামলা তিনটি ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। এ বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সাইফউদ্দিন শাহীন বলেন, ‘গত ১৫ বছর কারা কক্সবাজার অঞ্চলে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের একটি ডেটাবেজ করা হবে। এর ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।’ জেলার ২১ পয়েন্টে মানব পাচার হয় মন্তব্য করে পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘প্রয়োজনে এসব স্থানে ড্রোন নজরদারি করা যেতে পারে। সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানব পাচার বন্ধ করতে হবে।’
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমুদ্রপথে মানব পাচার এখনো প্রাণঘাতী হুমকি। ২০২৩ সালে সারা দেশে ১৩৭টি মানব পাচারের মামলা নথিভুক্ত হয়, যার মধ্যে প্রায় ৪৪ ভাগ ভুক্তভোগী কক্সবাজার জেলার। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৬৬ ভাগ ছিল পুরুষ, যা মানব পাচারের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত বৈচিত্র্য এবং নতুন ধরনের কৌশল ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়। অনেক পুরুষ ভুক্তভোগীকে বিদেশে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয় এবং পরে তাদের বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়।