চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত কমছে জলাশয়, বিশেষ করে পুকুর-দিঘি। প্রতিনিয়তই পুকুর-জলাশয় ভরাট করে তৈরি হচ্ছে বহুতল ভবন। আর এর প্রভাব পড়ছে প্রকৃতিতে। যা তরান্বিত করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তথ্য মতে, এ অঞ্চলে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে ১০ শতাংশ জলাশয়।
প্রভাবশালীর শকুনদৃষ্টি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা বৃদ্ধি, শিল্পের বিস্তারসহ নানা কারণে নগরীর পরিবেশ ও জলাধার সংরক্ষণ এখন চরম হুমকির মুখে। এক সময়ের টিলা, ছড়া, জলাশয়, দিঘি-পুকুরের শহর এখন বৈচিত্র্য ও শ্রীহীন এবং ইট-কংক্রিটের শহরে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০) অনুসারে, সরকারি বা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কোনো ধরনের জলাধার ভরাট করা নিষিদ্ধ। জানা যায়, সিডিএ নগরের জন্য নতুন করে মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজ করছে। তাদের পরিচালিত জরিপের পরিসংখ্যানে ১৯৭৮-৮৪ সালে চট্টগ্রাম শহরে পরিচালিত ‘বাংলাদেশ সার্ভে’ চট্টগ্রাম নগরে জলাশয়ের (পুকুর ও দিঘি) সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৬৪১টি। কিন্তু ২০২৩ সালে সিডিএর ফিল্ড জরিপে অস্তিত্ব মিলেছে মাত্র ২ হাজার ২৫১টি জলাশয়ের। গত ৩০ বছরে চট্টগ্রাম শহর থেকে ২ হাজার ৩৯০টি জলাশয় হারিয়ে গেছে। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, নগরের বাইরে চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলায় ২০২২ সালে পুকুর ও জলাশয়ের সংখ্যা ছিল ৪৮ হাজার ২৪৫টি। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিল মাসে এসে পুকুরের সংখ্যা পাওয়া যায় ৪৩ হাজার ৭৪৩টিতে। চার বছরে কমছে ৪ হাজার ৫০২টি পুকুর। সবচেয়ে বেশি জলাশয় হারিয়ে গেছে রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। ১ হাজারের বেশি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, নগরের পুকুর-জলাশয়গুলো দখলমুক্ত করে চারপাশে দৃষ্টিনন্দন ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। একই সঙ্গে নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে বাচ্চাদের জন্য পার্ক ও বসার জায়গার পরিকল্পনা আছে। ইতোমধ্যে পরিষ্কার করা খালের পাড়গুলোকে ওয়াকওয়ের উপযুক্ত করা হচ্ছে। শহরের ঐতিহ্যবাহী পুকুরগুলোও সংস্কার করা হবে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপপ্রধান পরিকল্পনাবিদ মো. আবু ঈসা আনছারী বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পুকুর-জলাশয় সংরক্ষণ করার কোনো বিকল্প নেই।
তাই নগর উন্নয়নে নতুন মহাপরিকল্পনায় পুকুর-জলাশয়ের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরে প্রায় ৫০টিরও বেশি পাড়ার নামকরণ করা হয়েছিল কাছাকাছি পুকুর-দিঘি-জলাশয়ের নামে। এর মধ্যে অনেকগুলো এখন অদৃশ্য হয়েছে। প্রায় শতবর্ষ আগে চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি প্রণীত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে চট্টগ্রাম নগর ও এর আশপাশের এলাকাগুলোয় বিভিন্ন ব্যক্তি বা বংশের নামে খনন করা ৩৭৬টি দিঘির কথা উল্লেখ আছে। তবে এসবের বেশির ভাগই এখন অস্তিত্বহীন। গত কয়েক দশকে হারিয়ে গেছে প্রসিদ্ধ অনেক পুকুর। নগরীর আন্দরকিল্লা এলাকার প্রায় এক হেক্টরের রাজা পুকুর লেন এক সময় বিশাল ‘কিং পুকুর’ (রাজা পুকুর)-এর জন্য পরিচিত ছিল। কিন্তু এটি এখন বহুতল ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছে। নন্দনকানন এলাকার ঐতিহ্যবাহী রথের পুকুরপাড় এখন বহুতল ভবনের নিচে হারিয়ে গেছে।