দীর্ঘ ৩২ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল ছাত্র সংসদ নির্বাচন ২০২৫- এর রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পূর্বঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামীকালই (৩০ এপ্রিল) জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মাঝে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জানা যায়, গত ১লা ফেব্রুয়ারি জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা থাকলেও জাকসুর সংস্কার ইস্যুতে ছাত্রদলের দাবির মুখে তা ঘোষণা করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরবর্তীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি ব্যানারের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ৩০ শে এপ্রিল তফসিল ঘোষণা এবং ২১ শে মে এর মধ্যে জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান।
তবে তফসিল ঘোষণার নির্ধারিত সময়ের মাত্র ১দিন বাকি থাকলেও এখন পর্যন্ত প্রশাসনের দৃশ্যমান কোন প্রস্তুতি দেখা যায়নি।
জাকসুর তফসিল ঘোষণার আগে কয়েকটি বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে প্রশাসন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো থেকে মেয়াদউত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বের করা, প্রতিটি হলে অবস্থানকৃত অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের স্ব স্ব হলে ফিরে যাওয়া, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের বিচার নিশ্চিত করা, জাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কার, এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রভৃতি।
তবে এগুলোর মধ্যে জাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কারের বিষয়টি বাস্তবায়িত হলেও অধিকাংশ সংস্কারের দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি দেখা যায়নি। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ দেখা গেছে।
ইতোমধ্যে নির্ধারিত সময়ে জাকসুর তফসিল ঘোষণা না হলে জাবির প্রশাসনিক ভবনে তালা লাগিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করার কথা জানিয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখা নেতারা। অন্যদিকে, তফসিল ঘোষণার পূর্বে জুলাই হামলায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের বিচার না করা হলে প্রশাসনিক ভবন অবরোধ, ঘেরাও কর্মসূচি পালন করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে শাখা ছাত্রদলের নেতারা।
ছাত্রদলের অভিযোগ, জাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কার ছাড়া এখন পর্যন্ত তাদের অধিকাংশ দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। সংগঠনটির নেতাকর্মীরা জুলাইয়ে হামলাকারী ছাত্রলীগের বিচার, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত প্রশাসনিক ব্যক্তিদের অপসারণসহ অন্যান্য সংস্কার কাজগুলো বাস্তবায়নের দাবিতে গত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন করে আসছে।
এবিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হলে হলে অবস্থান করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসররা বসে আছে। এরকম অনিরাপদ পরিস্থিতিতে জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। নইলে আমরা শীঘ্রই প্রশাসনিক ভবন অবরোধ, ঘেরাও এর মতো কঠোর কর্মসূচির ডাক দিতে বাধ্য হবো।
জাকসু নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, গণঅভুত্থান পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি জাকসু নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এর আগে যে তারিখ ঘোষণা করেছিল সেখানে একটি ছাত্র সংগঠনের চাপে সেই সময় তফসিল ঘোষণা করতে পারেনি। তারপর যখন আবার শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে দাবি উঠে তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রতিশ্রুতি দেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রক্তের উপর দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া প্রশাসনের প্রতিশ্রুতির উপর আমরা আস্থা রাখতে চাই। আমরা মনে করি, তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী ৩০ এপ্রিল জাকসুর তফসিল ঘোষণা হবে এবং ২১ মে এর মধ্যে জাকসু নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নিবে। তবে আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কিছু গড়িমসী লক্ষ করছি। যা কোনভাবে কাম্য নয়। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হল থেকে অছাত্রদের বের করা এবং জুলাই আন্দোলনের হামলাকারীদের বিচার করার জন যে সময় নিয়েছিল তার কোনো অগ্রগতি আমরা দেখছি না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সাথে দেখা করে এ সকল বিষয় জানিয়েছি। আমরা চাই শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি জাকসু নির্বাচন দ্রুত কার্যকর করা হোক। অন্যথায়, আমরা সচেতন শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে অবস্থান কর্মসূচির মতো কঠোর আন্দোলনের ডাক দিবো।
জাবি ছাত্র ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, জুলাই আন্দোলনে হামলাকারী ছাত্রলীগ ও কিছু শিক্ষককে সাময়িক বহিষ্কার করছে। তার জন্য অবশ্যই প্রশাসনকে সাধুবাদ জানাই। আমরা চাই জাকসু এবং সংস্কার দুটোই সমান্তরালে চলুক। আগামীকালই (৩০ এপ্রিল) জাকসুর তফসিল ঘোষণা হোক।
উল্লেখ্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ওইবছর প্রথম জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ, এক ছাত্রের বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে সেবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন বাতিল করে। এরপর ৩২ বছর পার হয়ে গেলেও জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল