নবায়নযোগ্য শক্তি
নবায়নযোগ্য শক্তির দ্রুত প্রসারে ইউরোপের অন্যতম উন্নত দেশ নেদারল্যান্ডস এখন পড়েছে এক অদ্ভুত সংকটে। সৌর ও বায়ুশক্তির সাফল্য দেশের বিদ্যুৎ গ্রিডে এতটাই চাপ সৃষ্টি করেছে যে, সে দেশের সরকারকে এখন জনগণকে নির্দিষ্ট সময় বিদ্যুৎ ব্যবহার সীমিত করতে অনুরোধ জানাতে হচ্ছে
নেদারল্যান্ডসের জাতীয় টেলিভিশনে সম্প্রতি প্রচারিত এক বার্তায় দেখা যায়, একজন অভিনেত্রী দর্শকদের উদ্দেশে বলছেন, ‘যখন আমরা সবাই একই সময়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি, তখন গ্রিডের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। তাই বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে যতটা সম্ভব কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করুন।’ সরকারি এই প্রচারণার নাম-‘সুইচ উল্টাও’ (Flip the Switch)। উন্নত প্রযুক্তি ও শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ নেদারল্যান্ডসের এমন সতর্কতা একটিই বার্তা দিচ্ছে-নবায়নযোগ্য গ্রিন পাওয়ারের দ্রুত সম্প্রসারণের চাপ সামলাতে দেশটির বিদ্যুৎ গ্রিড হিমশিম খাচ্ছে।
নবায়নযোগ্য শক্তির উত্থান
ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার থেকে শুরু করে সৌর প্যানেল স্থাপন-সবক্ষেত্রেই ইউরোপের শীর্ষে থাকা দেশটি নেদারল্যান্ডস। এখানে মাথাপিছু চার্জিং পয়েন্টের সংখ্যা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। দেশটির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বাড়িতে সৌর প্যানেল স্থাপিত এবং ২০৩০ সালের মধ্যে অফশোর উইন্ড ফার্মকে (সমুদ্রের ওপর স্থাপিত বায়ু খামার) প্রধান বিদ্যুৎ উৎস করার পরিকল্পনা রয়েছে। পরিবেশবান্ধব এই রূপান্তর নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে নবায়নযোগ্য শক্তির এই ‘সবুজ জোয়ার’ এখন পরিণত হচ্ছে বিদ্যুৎ গ্রিডের জন্য এক দুঃস্বপ্নে।
গ্রিড কনজেশনের জটিলতা
জ্বালানি কোম্পানি Eneco-এর প্রধান নির্বাহী কিস-জান রামো এই সংকটকে বলেন ‘গ্রিড কনজেশন’ বা গ্রিডে যানজট। তার ভাষায়, ‘গ্রিড কনজেশন হলো বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় ট্রাফিক জ্যামের মতো অবস্থা। কোথাও চাহিদা বেশি, কোথাও আবার উৎপাদন অতিরিক্ত, ফলে বিদ্যুৎ প্রবাহে ভারসাম্য থাকে না।’ পুরোনো কাঠামোর গ্রিড তৈরি হয়েছিল এমন সময়ে, যখন বিদ্যুৎ সরবরাহ হতো অল্পসংখ্যক বড় গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। ঘরোয়া সৌর প্যানেল ও ছোট বায়ু টারবাইনের সংখ্যা বাড়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে গ্রিডের প্রান্ত থেকে, যেখানে বিদ্যুৎলাইন তুলনামূলকভাবে দুর্বল। বিপুল উৎপাদন বিদ্যুৎ গ্রিডের ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, ফলে প্রায়ই দেখা দিচ্ছে বিভ্রাট।

বিনিয়োগে ঘাটতি, সমস্যা মহাদেশজুড়ে
বেলজিয়ামের লিজ ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ডামিয়েন আর্নস্ট বলেন, ‘নেদারল্যান্ডস তাদের বিতরণ নেটওয়ার্কে যথেষ্ট বিনিয়োগ করেনি। ফলে তারা সর্বত্র বাধার মুখে পড়ছে। এই সমস্যা সমাধান করতে বছর এবং বিলিয়ন ইউরো লাগবে।’ তিনি আরও সতর্ক করেন, এটি শুধু নেদারল্যান্ডস নয়, পুরো ইউরোপের সমস্যা। আমরা যত দ্রুত সৌর প্যানেল বসাচ্ছি, সেই হারে গ্রিড উন্নয়ন ঘটছে না।
ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা
Eneco তাদের ‘ভার্চুয়াল পাওয়ার প্ল্যান্ট’ সিস্টেমের মাধ্যমে গ্রিড ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় তারা কিছু বায়ু টারবাইন ও সৌর প্যানেল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। আবার চাহিদা বাড়লে কিছু গ্রাহকের সরবরাহ সীমিত করা হয়-অবশ্য তারা এর বিনিময়ে কম মূল্যে বিদ্যুৎ পায়। তবে যেসব পরিবার বা প্রতিষ্ঠান নতুন সংযোগ বা বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিধি বাড়াতে চায়, তাদের জন্য সমস্যা বাড়ছে। অনেকেই হিট পাম্প বা ইলেকট্রিক গাড়ির চার্জার বসাতে চাইলেও প্রয়োজনীয় সংযোগ পাচ্ছেন না। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। অনেকে উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে।
অপেক্ষমাণ তালিকার দীর্ঘ লাইন
নেদারল্যান্ডসের সরকারি সংস্থা Tennet জানিয়েছে, বর্তমানে প্রায় ৮,০০০ প্রতিষ্ঠান গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের অনুমতি পেতে অপেক্ষায়, আর ১২,০০০ প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ ব্যবহারের অনুমোদনের জন্য লাইনে। এমনকি নতুন আবাসিক প্রকল্পও বিলম্বিত হচ্ছে, কারণ গ্রিডে সংযোগ দেওয়ার সক্ষমতা নেই।
অর্থনীতিতে ক্ষতি
ডাচ কেমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নিয়েনকে হোমান সতর্ক করেছেন, গ্রিড কনজেশন দেশের শিল্প খাতের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করছে। একই কথা বলছে Boston Consulting Group-এর ২০২৪ সালের রিপোর্ট-গ্রিড কনজেশনের কারণে ডাচ অর্থনীতি বছরে কমপক্ষে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ইউরো ক্ষতির মুখে পড়ছে।
সরকারের পরিকল্পনা
বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় Tennet গ্রিড সম্প্রসারণে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে, যার মাধ্যমে ২০৫০ সালের মধ্যে ১ লাখ কিলোমিটার নতুন ক্যাবল বসানো হবে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে গড়ে ১০ বছর সময় লাগে, যার মধ্যে প্রথম আট বছরই কাটে আইনগত প্রক্রিয়ায়। ডাচ জ্বালানিমন্ত্রী সোফি হারম্যান্স স্বীকার করেছেন, ‘আমরা হয়তো বিদ্যুৎ ব্যবহারের বৃদ্ধির গতি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি।’ এখন সরকার ‘জাতীয় গ্রিড কনজেশন অ্যাকশন প্ল্যান’ হাতে নিয়েছে, যাতে অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত করার পাশাপাশি জনগণকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতনে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
‘সুইচ উল্টাও’ প্রচারণা এখন ডাচ নাগরিকদের জন্য কেবল সচেতনতা নয়, একটি সতর্ক সংকেতও। সবুজ শক্তিতে অগ্রগতি যেমন জরুরি, তেমনই শক্তিশালী অবকাঠামোও অপরিহার্য। পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের পথে নেদারল্যান্ডসের এই অভিজ্ঞতা গোটা বিশ্বের জন্য এক শিক্ষণীয় বার্তা-‘শক্তি রূপান্তর কেবল প্রযুক্তির নয়, অবকাঠামোরও চ্যালেঞ্জ’।
তথ্যসূত্র : বিবিসি