যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। এখনো বটের শেকড়ে ঝুলছে ৩০০ বছরের ইতিহাস। এমন ভগ্নদশা কুমিল্লা গোমতী নদীর পাড়ে অবস্থিত নুরজাহান মসজিদের। জনশ্রুতি আছে, এই মসজিদে কখনো আজান ও নামাজ হয়নি। কারণ এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ত্রিপুরা মহারাজা দ্বিতীয় ধর্ম-মানিক্যের রাজদরবারের একজন নর্তকী। কুমিল্লা নগরীর চাঁনপুর গোমতী ব্রিজ পার হয়ে নদীর উত্তরপাড় ঘেঁষা মাঝিগাছা নন্দীর বাজার সড়কের বামপাশে এই মসজিদের অবস্থান। এটি দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে মানুষ ভিড় জমান। প্রাচীন মসজিদটি সংরক্ষণ করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। স্থানীয়দের ধারণা, এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৭১৪-১৭৩৪ সালের মাঝে। মসজিদের পূর্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম পাশে সমিল ও দোকান রয়েছে। এতে মসজিদটি আড়াল হয়ে গেছে। উত্তর পাশে কবরস্থান রয়েছে। মসজিদের গম্বুজের একাংশ ভেঙে পড়েছে। দেয়ালগুলোও ফাটা। গাছের শেকড় আঁকড়ে ধরে এখনো টিকে আছে মসজিদটি। জনশ্রুতি রয়েছে, গোমতীর উত্তরপাড়ে মাঝিগাছা গ্রামে তিন বোন নুরজাহান, মোগরজান ও ফুলজান বাস করতেন। একদিন কিশোরী নুরজাহানকে সাপে কামড়ালে ভেলায় তাকে গোমতী নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ত্রিপুরা মহারাজার রাজদরবারের ব্যক্তিরা তাকে দেখে রাজপ্রাসাদে নিয়ে সুস্থ করে তোলেন। পরবর্তীতে রাজদরবারের মেনেকা তাকে নাচ-গান শিখিয়ে সেরা নর্তকীতে পরিণত করেন। নর্তকী পেশায় রাজা-মহারাজাদের দরবারে প্রায় ৩৫ বছর কাটানোর পর মধ্য বয়সে নুরজাহান রাজদরবার থেকে বিদায় নিয়ে জন্মস্থান মাঝিগাছায় একজন জমিদারের বিধবা স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস শুরু করেন। প্রাসাদ ছেড়ে আসার সময় ত্রিপুরার মহারাজা নুরজাহানকে মাঝিগাছায় কয়েক একর জমি, প্রচুর অর্থ ও স্বর্ণালংকার দান করেন। তিনি গ্রামের মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। একসময় অতীত কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্তের জন্য নুরজাহান এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। নুরজাহান গ্রামবাসীর সঙ্গে বসে মসজিদে নামাজ পড়ার দিন-তারিখ ধার্য করতে সভা ডাকেন। এর মধ্যে নুরজাহানের অতীত জীবন জানাজানি হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় নুরজাহানের অর্থে নির্মিত মসজিদে কেউ নামাজ পড়বেন না। সেই সিদ্ধান্তের পর থেকেই এ মসজিদে কোনো দিন আজান হয়নি। কেউ নামাজ পড়েননি। এ ঘটনার পর নুরজাহান দুঃখে-কষ্টে নিজ গৃহে একাকিত্ব জীবন কাটিয়েছেন বেশ কয়েক বছর।
অনেকের মতে, গ্রামের মানুষের ওই আচরণে আঘাত পেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন নুরজাহান। কারও মতে, গ্রামের মানুষের অপবাদ সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তার নির্মিত মসজিদের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে। লেখক আহম্মেদ কবীর বলেন, এই মসজিদটির প্রকৃত ইতিহাস কেউ জানেন না। এটি নিয়ে প্রথম তিনি একটি উপন্যাস লিখেছেন ‘নুরজাহান বাঈয়ের মসজিদ’ নামে। যা ছিল জনশ্রুতি ও কল্পনার মিশ্রণ। পরবর্তীতে এটি নিয়ে আরও অনেক লেখালেখি হয়েছে। মসজিদটি এখন ধ্বংসের মুখে রয়েছে। স্থানীয় নুরে আলম ও মমিন মিয়া বলেন, কোনো অলৌকিক কারণে হয়তো এটি এখনো টিকে আছে। এ ছাড়া ভিতরটা মোটামুটি পরিষ্কার। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান বলেন, ‘এটি বিভিন্ন সময় পরিদর্শন করেছেন। কুমিল্লা নগরীর নিকটবর্তী গোমতীর পাড়ের মসজিদটি সংরক্ষণ করা যেতে পারে।’ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানা জানান, এটি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।