পুরো নাম আ হ ম মুস্তফা কামাল। সবাই তাকে ডাকে লোটাস কামাল বলে। কিন্তু এই লোটাস সৌন্দর্য ছড়ায় না, ছড়ায় দুর্নীতি। এই পদ্ম মানুষকে আনন্দ দেয় না, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে। এই পদ্মে চোখ জুড়ায় না, আতঙ্ক ছড়ায়। লোটাস কামাল শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এক স্বীকৃত লুটেরা। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে তিনি পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। ছিলেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছরে (১৮২৬ দিন) মাত্র ৭২ দিন অফিস করে অনন্য বিশ্ব রেকর্ড করেছেন। বলা হতো তার ‘ডিমেনসিয়া’ হয়েছে। অর্থাৎ নিকট অতীতের সবকিছু ভুলে যেতেন। সবকিছু ভুলে গেলেও ‘টাকা’ ভুলে যাননি। ভুলে যাননি ‘দুর্নীতি’। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি থেকে, ব্যাংক লুট, জনশক্তি রপ্তানিতে প্রতারণা থেকে টেন্ডার জালিয়াতি- কোন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না সাবেক এই অর্থমন্ত্রী! বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের অর্থনীতির যারা বারোটা বাজিয়েছে তাদের অন্যতম হলেন লোটাস কামাল। সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ সাত দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বাংলাদেশে তার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। কিন্তু এই লুটেরা এখন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। লুটের টাকায় সপরিবারে অবস্থান করছেন দুবাইতে। তবে মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং কাতার, সৌদি আরব এবং দুটি দ্বীপ রাষ্ট্রে রয়েছে তার বিপুল সম্পদ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুবাইতে অন্তত ১৮টি নিবন্ধিত কোম্পানি রয়েছে লোটাস কামাল এবং তার পরিবারের। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইউ ট্যাক্স অবসেরভেটরি (ইউ ট্যাক্স) চলতি বছরের ১৬ মে প্রকাশিত তথ্যে জানিয়েছে, ২০২২ সালে দুবাইয়ে আবাসন খাতে ৫৩২ জন বাংলাদেশি প্রপার্টি মালিকানা অফ প্ল্যান অর্থাৎ (উন্নয়ন বা নির্মাণ শেষের আগেই কিনে নেওয়া) প্রপার্টির মালিকানার হিসাব পাওয়া গেছে। এই তালিকায় লোটাস কামাল ও তার পরিবারের নাম রয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে অনুসন্ধান করে পাওয়া যায় বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। দেখা যায়, সেখানে অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছে নির্মাণ সংস্থা হিসেবে। অরবিটাল ইন্টারন্যাশনালের অন্যতম মালিক দেখানো হয়েছে কাশমেরি কামালকে। এই অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশেও নিবন্ধিত, তবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কাজ ছিল জনশক্তি রপ্তানি করা। এখন দুবাইতে অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল একটি নিবন্ধিত কোম্পানি হয়ে সেখানে কনস্ট্রাকশন এবং আবাসন খাতে কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাগজপত্র অনুসন্ধান করে দেখা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন এলাকায় তারা ছয়টি আবাসন প্রকল্পের কাজ একযোগে শুরু করেছে। এই ছয়টি আবাসন প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ লোটাস কামালের স্ত্রী কাশমেরি কামাল এই টাকাগুলো বিদেশে পাচার করে সেখানে নতুন করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন এলাকায় কাশমেরি কামাল, নাফিসা কামাল এবং লোটাস কামালের নামে অন্তত ১৮টি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। দুবাইয়ের অভিজাত ব্যয়বহুল পামবিচ এলাকায় নাফিসা কামালের একটি ব্যক্তিগত বাংলো বাড়ি রয়েছে, ঠিক পাশেই কাশমেরি কামালেরও একটি বাংলো বাড়ি রয়েছে। সেই বাংলো বাড়িটি বর্তমানে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, নাফিসা কামাল সেখানে এনকে স্পোর্টস (নাফিসা কামাল স্পোর্টস) নামে একটি কোম্পানি তৈরি করেছেন। যে কোম্পানির কাজ হলো বিভিন্ন খেলাধুলা-সংক্রান্ত চ্যারিটি এবং ইভেন্ট আয়োজন করা। সেই ইভেন্ট কোম্পানির অন্যতম একজন পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের নাম রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের পরিমাণ বাংলাদেশি টাকায় ৭৫০ কোটি টাকা বলে জানা গেছে। দুবাইতে যে ১৮টি বাড়ি রয়েছে তার মধ্যে আ হ ম মুস্তফা কামালের বাড়ি এবং ফ্ল্যাট রয়েছে তিনটি। কাশমেরি কামালের বাড়ির সংখ্যা রয়েছে ৯টি এবং তার মেয়ে নাফিসা কামালের বাড়ির সংখ্যা রয়েছে ৪টি। এ ছাড়াও তার অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের নামে বাকি বাড়ি নিবন্ধিত। সব বাড়ির হিসাব যদি করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, এসব বাড়ির মূল্য বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯৩৭ কোটি। এই টাকা অবৈধভাবে লোটাস কামাল দুবাই পাচার করেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাস করে এমন ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, লোটাস কামাল দুবাইয়ের পার্মানেন্ট রেসিডেন্স কার্ডধারী। তিনি সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা এবং ব্যবসা করার অধিকার রাখেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১১ সালে লোটাস কামাল দুবাইতে স্থায়ী বসবাসের জন্য স্থায়ী পারমিট গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারিতে লোটাস কামাল হাজার হাজার কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এই অর্থ দিয়েই তিনি দুবাইতে তার সাম্রাজ্য করা শুরু করেছেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে তার কাশমেরি কামাল সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্থায়ী নাগরিক। নাফিসা কামালও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।
নাফিসা কামালের এনকে স্পোর্টস ছাড়া আরও চারটি নিবন্ধিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ফ্যাশন হাউস বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে নাফিসা কামাল পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ডিজাইন পোশাক আমদানি করেন এবং সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্রি করেন। ফ্যাশন হাউজ সংযুক্ত আরব আমিরাতে একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত। দুবাই ও শারজাহ শহরে নাফিসা কামালের এই ফ্যাশন ডিজাইনের ছয়টি আউটলেট রয়েছে। এসব আউটলেটের মাধ্যমে আমদানিকৃত দামি বিলাসী পোশাক বিক্রি করা হয়। সম্প্রতি নাফিসা কামাল সেখানে একটি কসমেটিকস কোম্পানি খুলছেন। এই কসমেটিকস কোম্পানি বিশ্বের অন্যান্য দামি ব্র্যান্ডের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। জানা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ এটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। শারজাহতে এই কসমেটিক ফ্যাক্টরির জন্য জমি ক্রয় করা হয়েছে বলেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জয়েন্ট ইনভেস্টমেন্টের তথ্যে জানা যায়। অর্থাৎ সংযুক্ত আরব আমিরাতে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত এখন লোটাস কামাল এবং তার পরিবার। তবে শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতেই লোটাস কামালের অবৈধ সম্পত্তির ঠিকানা নয়। মধ্যপ্রাচ্যের আরও কয়েকটি দেশেও তার অবৈধ পাচার করা অর্থের বিনিয়োগ আছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত কাতারে বিশ্বকাপের সময় লোটাস কামালের মেয়ে নাফিসা কামাল সেখানে বিনিয়োগ করেছেন। এই বিনিয়োগের সূত্র ধরে তিনি কাতারে এখন একজন নিবন্ধিত ব্যবসায়ী। যিনি কাতারে যে কোনো অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন। কাতারের স্টক এক্সচেঞ্জে নাফিসা কামালের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে তিনি ঠিক কত বিনিয়োগ করেছেন সেই তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ছাড়াও নাফিসা কামাল এবং কাশমেরি কামাল সৌদি আরবেও একটি শপিং মল তৈরির জন্য অনুমতি চেয়েছেন। ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর সৌদি ফরেন ইনভেস্টমেন্ট ডিপার্টমেন্টে এই আবেদন করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত এই শপিং মল তৈরি করার অনুমতি পাওয়া যায়নি। সৌদি আরবের দুটি ফুটবল ক্লাবের শেয়ার কেনার জন্য নাফিসা কামাল আবেদন করেছেন। এসব শেয়ার কিনতে গেলে ন্যূনতম বাংলাদেশি মুদ্রা ৫০০ কোটি টাকার জামানত প্রয়োজন হয়। নাফিসা কামাল আল নাহিয়ান ক্লাবসহ আরেকটি ক্লাবের শেয়ারের জন্য আবেদন করেছেন বলে আল নাহিয়ান ক্লাব সূত্রে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১০ সাল থেকেই লোটাস কামাল বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করা শুরু করেন এবং দুবাই কেন্দ্রিক একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। দুবাই ঠিকানা দিয়েই লোটাস কামাল লন্ডনে একটি বাড়ি কিনেছেন। যেখানে তার ছোট মেয়ে অবস্থান করছেন। এ ছাড়াও লন্ডনে তার ছোট মেয়ের নামে ব্যবসা রয়েছে। দুবাই ঠিকানা ব্যবহার করেই লোটাস কামাল সুইস ব্যাংকেও টাকা জমা রেখেছেন বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে সুইস ব্যাংক তার গ্রাহকদের নাম প্রকাশ করে না বলে এখন পর্যন্ত এ সম্পর্কে কোনো বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি।
প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব নিয়েছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বিষয়ে তদন্তে জানা গেছে, লোটাস কামাল আসলে তার আসল নাম আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তফা কামাল ব্যবহার করে দেশটির পাসপোর্ট নিয়েছেন। ভানুয়াতুতে নাগরিকত্ব কেনার মাধ্যমে লোটাস কামাল এখন ১৩০টি দেশে ভিসামুক্ত ভ্রমণ করতে পারবেন, এটি একটি সুযোগ যা বিশ্বের বহু বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরা লাভ করছেন। ভানুয়াতুর পাসপোর্টধারীদের জন্য এই সুবিধা আকর্ষণীয়, কারণ দেশটি আয়কর, করপোরেট কর বা সম্পদ কর না নেওয়ার কারণে অর্থ পাচারের জন্য একটি নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে পরিচিত।
ভানুয়াতু সরকার ‘গোল্ডেন পাসপোর্ট’ নামে একটি স্কিমের আওতায় নাগরিকত্ব বিক্রি করে, যার মাধ্যমে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলারের বিনিময়ে নাগরিকত্ব প্রাপ্তি সম্ভব। এই প্রক্রিয়া এক মাসের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যায় এবং সরাসরি দেশটিতে না গিয়েও নাগরিকত্ব পাওয়া যায়, যেটি লোটাস কামাল কাজে লাগিয়েছেন।