যুদ্ধের সময় আমরা তাঁর পাশে না থাকলে আমার আব্বার ভয় করত না। একাকী থাকলে তিনি পাত্তা দিতেন না। তাঁর আশঙ্কা যে তাঁর সামনে আমরা মারা যাব, সেজন্য তিনি আমাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন সব সময়। সেটা তিনি চাইতেন না। আমি শুনেছি তিনি আম্মাকে বলছিলেন, আমার ভয় হয় আমি সেই ব্যক্তি যার জন্ম হয়েছে পাশের সবাই মারা যাওয়ার পরও যে বেঁচে থাকবে। সংঘর্ষের ঘটনা বৃদ্ধি পেলে তিনি রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিতেন যেন বোমাবর্ষণের শব্দ চাপা পড়ে যায়। তার মানে হলো তিনি কখন ভয় পাচ্ছেন তা আমরা বুঝতে পারতাম। যে গান আমরা কখনো শুনিনি সে রকম একটা পপ, রক, লোকগীতি, জাজ বা ক্ল্যাসিক্যাল গান খুঁজে পাওয়ার দক্ষতা ছিল তাঁর। আমরা তাঁকে গানের অর্থ ব্যাখ্যা করতে বলতাম, তিনি বলতেন এটা এমন এক লোকের গল্প যার জীবনে কিছু ঘটে না। তিনি বলতেন এটা সেই একই গান যেটা আমরা গতবার শুনেছি।
আমরা ছোটরা আশ্চর্য হয়ে ভাবতাম কীভাবে আমার আব্বা প্রত্যেকবার একই গান খুঁজে বের করতে সক্ষম হতেন, যদিও তার সুর কিছুটা ভিন্ন। আমরা এ-ও বুঝতাম যে তিনি আমাদের নিচে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার জন্য চাপাচাপি করতেন, যেন তিনি অস্ত্রধারীদের সঙ্গে লড়াই করতে পারেন।
আমাদের চারপাশে সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, আমরা বুঝতে পারি না তাদের মধ্যে কারা বীর আর কারা চোর। তবে আমরা নিশ্চিত ছিলাম আমার আব্বা বীরদের পক্ষে আছেন। কিন্তু সত্য একেবারেই তার বিপরীত ছিল। আমরা আশ্রয়স্থলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আব্বা বসার ঘরের মেঝেতে তাঁর ছবি আঁকার খাতা নিয়ে শুয়ে পড়তেন, গায়ের ওপর জড়িয়ে নিতেন সাহায্য হিসেবে পাওয়া পাঁচটা ভারী বুলেটপ্রুফ কম্বল। কমিক বইয়ের অঙ্কনশিল্পী হওয়ার আকাক্সক্ষা ছিল তাঁর। তাঁর কল্পনাশক্তি গল্প লেখার মতো প্রখর ছিল না, তবু তিনি চেষ্টা করতেন, শিশুদের অঙ্কনের মতো, মূক চরিত্র আঁকতেন। বেশির ভাগ অস্ত্রধারী এবং শিশুদের ছবি। কিন্তু কোনো বর্ণনা থাকত না। তিনি বলতেন, তিনি লিখতে পারেন না কারণ আমাদের নিয়ে তাঁর জীবনে কিছু ঘটেনি।
একদিন, স্কুলের ছেলেরা বলাবলি করছিল এটা কী করে হয় যে যুদ্ধে যাওয়া অস্ত্রধারীদের এবং রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো অস্ত্রহীন লোকদের কেউ চেনে না? তখন আমি বললাম, আমরা নিচে আশ্রয় নিলে আমার আব্বা যুদ্ধ করতে যান। ছেলেদের কেউ আমাকে তাঁর ইউনিফর্ম সম্পর্কে জানতে চাইল না, আমি আমার আব্বার নোটবুকে আঁকা অস্ত্রধারীর ইউনিফর্মের বর্ণনা দিলাম। কয়েক দিন পর, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে সশস্ত্র লোকেরা এসে আমার আব্বাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। তারা একটা মিলিটারি ইউনিফর্মের খোঁজ করছিল, যেরকম ইউনিফর্মের বর্ণনা আমি স্কুলে দিয়েছিলাম। বাহ্যত, আমার পিতা মৃদু হেসেছিলেন, বলেছিলেন, অবশেষে কিছু-একটা ঘটতে চলেছে তাহলে। আমি আমার স্কুলের সহপাঠীদের বলেছিলাম যে, অস্ত্রধারীরা আমার আব্বাকে কিডন্যাপ করেছে, তবে বীররা তাঁকে উদ্ধার করবেন। সপ্তাহের পর সপ্তাহ গেল, তারপর মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর, কিন্তু তাঁর টিকিটিরও কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না।
আমাদের, ওই দালানের অন্যান্য বাসিন্দাসমেত, জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। আমরা বাস্তুচ্যুত হলাম এবং বলা হলো যুদ্ধ শেষ হলে অ্যাপার্টমেন্টে থাকার কোনো অধিকার আমাদের থাকবে না। আমার মা বাড়ির দরোজায় আমাদের নতুন ঠিকানা লেখা কাগজ ঝুলিয়ে দিলেন যেন, ফিরে এসে আব্বা সেটা পড়তে পারেন। ওই কাগজের টুকরোটা মাসের পর মাস সেখানে ঝুলে থাকল, যতক্ষণ পর্যন্ত না দালানের মেরামতির কাজ করার সময় মালিক সেটা খুলে ফেলে দিল। এটা জানতে পেরে আমার মা আব্বাকে ফিরে আসার আবেদন জানিয়ে আমাকে সংবাদপত্রে লিখতে বললেন। আমি তাঁকে বুঝালাম যে আমার আব্বা নিখোঁজ। তিনি জোরেশোরে বলতে লাগলেন যে তিনি এখনো বেঁচে আছেন, কিন্তু তিনি বোকা মানুষ, হয়তো ভাবছেন আমরা মারা পড়েছি, সে জন্য তিনি আমাদের খোঁজার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করছেন না। আমার মা আমাকে তাঁর উদ্দেশে এমনভাবে লিখতে বললেন, যেন তিনি বুঝতে পারেন যে আমাদের জীবনে সেরকম কিছু ঘটেনি যার আশঙ্কা তিনি সব সময় করতেন- আমাদের জীবনে কিছু ঘটেনি। তিনি আমাকে নিশ্চিত করতে বললেন যেন পত্রটা প্রত্যেকবার ভিন্ন ভিন্ন আকারের হয়। তিনি বললেন, তোমাদের আব্বা মোটের ওপর একজন শিল্পী, যদি তিনি দেখেন যে আমরা বারবার একই রকম কথা লিখছি তাহলে হয়তো মনে করতে পারেন আমরা তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিচ্ছি না, এই কারণে আমাদের ত্যাগ করে যাওয়ার অধিকার আছে তাঁর।
সুতরাং আমি তা-ই করলাম।
এটাই আমার প্রথম লেখার চেষ্টা। তিন-চার লাইনের একটা সাধারণ বিজ্ঞাপন, প্রত্যেক মাসে সংবাদপত্রে ছাপাতে লাগলাম। আমি কী লিখি সেটা আমার মা কখনো পড়ে দেখেন না বা এর বিষয় সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করেন না। তিনি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন আর আমাকে বিজ্ঞাপন প্রকাশের খরচ জোগান দেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে এটা পড়লে তাঁর কষ্ট হবে। একটা আশ্চর্য রকম অন্তর্দৃষ্টি তাঁকে এই কথা বলে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে আমার লেখা আমার পিতাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনবে। এভাবে, আমি ওই কয়েকটা লাইন নিয়ে দিন কাটাতে লাগলাম, একই বিষয়ের বর্ণনা দিয়ে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন আঙিকে। সেটা একেবারে ওই গানগুলোর মতো, যেগুলো আমার আব্বা বোমাবর্ষণের সময় রেডিওতে শুনতেন। যেটা ঘটবে বলে আমার মা আশা করতেন সেটাই ঘটল, একদিন আমার আব্বা ফিরে এলেন। তিনি মারাত্মক কষ্টে ছিলেন, তার মুখে উদ্বেগ, অবসাদ এবং দুঃখের চিহ্ন। কিন্তু, আধ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর অভিব্যক্তি রাগে পরিণত হলো এবং আমাদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়ে গেল। তিনি বললেন যদি আমি লেখক হতে চাই তাহলে আমার ব্যক্তিগত রচনা পরিহার করা উচিত, কারণ এটা ভালো হচ্ছে না। এই চেষ্টা করা মানে এটার অপব্যবহার করা। তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ সত্ত্বেও, আমার মনে হলো, তিনি আসলে অন্য কিছু চাইছেন : সাহায্য। কিন্তু আমি কিছু করিনি। আমি এমনকি লেখালেখিই বন্ধ করে দিলাম।
এখন, এতগুলো বছর পর, আমার অতীত জীবনকে স্মরণ করা মানে একটা হলোগ্রাফিক ছায়াকে অনুসরণ করা, যা যে কোনো মুহূর্তে অন্য ব্যক্তির রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। সে কারণে শেষ পর্যন্ত, আমি যাদের মতো হতে চেয়েছিলাম সেই সব লোকের সম্পর্কে লিখতে লাগলাম। আমার আব্বা অবশ্য তাদের অন্তর্ভুক্ত নন। তবুও আমি তাঁকে নিয়ে লিখতে আগ্রহী, কারণ আমি অনুধাবন করতে পেরেছি, তাঁর চরিত্র চিত্রায়ণে আমার ব্যর্থতা আমি যে সত্যি-সত্যিই লেখার অপব্যবহার করছি সেই রকমভাবে নিজেকে উপস্থাপন করার সুযোগ করে দেবে, যেরকম আমি হব বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন। সেজন্য আমি অন্য কারও সম্পর্কে লিখি, যার মতো হতে পারবেন বলে আমার পিতা মনে করতেন। আপনি ভাবছেন সংবাদপত্রে আমি কী প্রকাশ করেছি, কী আমার পিতার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে আমি ভেবেছিলাম, কয়েকটা মাত্র লাইন যার জন্য বেশি খরচ হবে না?- সেটা হলো একটা মৃত্যুর বিজ্ঞপ্তি। প্রায় প্রত্যেক মাসে, আমি আমার তিন ভাইয়ের মধ্য থেকে একজনের মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করতাম, প্রথমে তারা বিচলিত হয়েছিল, তারপর সেটা একটা কৌতুকে পরিণত হয়েছিল। তাহলে তোমার নিজের মৃত্যু সংবাদ কবে লিখছ তুমি? তারা জিজ্ঞেস করত, তারা আমাকে অবসেসিভ বলে চিহ্নিত করেছিল। তাদের দৃষ্টিতে, আমি যে লেখক হতে চেয়েছিলাম, সেটা একটা কাজের কাজ ছিল। আমার আব্বা আর কখনো কমিকচর্চা করেননি। এখন, তিনি খুব কমই গান শোনেন। আর তাঁর ধারণা, আমি লিখি শুধু আমাদের তাঁর ছেড়ে যাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রায়ই, আমাদের ঝগড়ার সময়, আমি আমার ফোনের প্লে-লিস্ট খুলে ভলিউম বাড়িয়ে দিই। তিনি কাছে এসে বলেন, তুমি ভয় পেয়েছ! তাই না? বলো এটা! বলো!
মাজেন মারুফ
ফিলিস্তিনি যুবক মাজেন মারুফ কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং সাংবাদিক। ইসরায়েলি দখলদারির মুখে তাঁর পরিবার লেবাননে পালিয়ে যায়। সেখানে ১৯৭৮ সালে তাঁর জন্ম। তিনি লেবানন ইউনিভার্সিটি থেকে রসায়নে গ্র্যাজুয়েশন করেন। কয়েক বছর শিক্ষকতা করার পর ২০০১ সালে সাহিত্য ও সাংবাদিকতাকে পেশা ও নেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কবিতা দিয়ে তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু। ২০১১ সাল পর্যন্ত তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এ সময় তিনি অনুবাদ এবং শিল্প ও সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধও লিখেছেন। তারপর ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন। ২০১৯ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জোকস ফর দি গানমেন’ (২০১৬) ম্যানবুকার ইন্টারন্যাশনাল বুকার প্রাইজের জন্য লং-লিস্টভুক্ত হয়। কবিতা ও ছোটগল্পের জন্য তিনি দেশ-বিদেশে অনেক পুরস্কার লাভ করেন। বর্তমানে আইসল্যান্ডে বসবাস করছেন।