গল্প
জানালার গ্রিল পেরিয়ে বাঁশির সুর ধেয়ে আসছে। একটু আগে রংধনু রং বিছানায় লুটোপুটি খেয়েছিল। গরুর চারণ জল, খড়ের গাদা চুইয়ে ডোবার দিকে গড়াচ্ছে। সকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। উঠোনের ভাঙাচালার নিচে মা সামান্য ইফতার ও রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দীর্ঘদিনের রোজায় বেচারার মুখটা পাংশুটে।
রান্নাচালার অদূরে বসেই এখানে বাবা ছেঁড়া জাল জুড়তেন। দাদার মাছ ধরার বাতিক ছিল বলেই ছেলেবেলায় বাবা সেই অভিযানের শরিক হতেন। তারপর থেকে সে বিদ্যে বাবারও রপ্ত হয়ে যায়। সেই বদঅভ্যাসবশত বিদ্যালয়ে যাবার আগে খ্যাপলা জাল ক্ষেপিয়ে প্রায় শূন্য থলিতে বাড়ি ফিরতেন বাবা। বাবার ওপরে কথা বলার সাহস মায়ের কখনো ছিল না। শুধু মৃদুস্বরে বলতেন, ‘খুব উদ্ধার করে এলেন।’ এই কথা বাবার কান পর্যন্ত যেত না। বাবা ছিলেন একজন উৎসবমুখর ও ভোজনবিলাসী মানুষ। সাধ্যের চেয়ে সাধ ছিল অগাধ। বেসরকারি বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। নীরার দাদাও ছিলেন প্রাথমিকের এন্ট্রাস পাস হেড পণ্ডিত। অবসরে পণ্ডিতমশায় সুযোগ পেলেই ইংরেজি কষিয়ে দিতেন। একবার বাবার সহকর্মীকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন তিনি।
ইছামতী নদীর ধারে বুড়ো বট গাছের নিচে ঘানিভাঙা সরিষার তেল মেখে পথে যাওয়া ছেলে ছোকরাগুলোকে নিত্যদিন ইংরেজি গ্রামারের গ্রামগঞ্জে নিয়ে যেতেন। কাউকে আর্টিকেলের ব্যবহার, কাউকে স্পেলিং বা টেন্স ধরে বসতেন। বিষয়টি বাবা একদম নিতে পারতেন না। অথচ গর্বভরে মা সেটি উপভোগ করতেন। বলতেন, ‘আমার বাবার বাড়ির কারও ইংরেজিতে এত দখল নেই।’
তাই বলে আমাদের ভাষার দখল কম ছিল না। ছোটবেলায় কত বই যে পড়েছি, ‘লালু ভুলু’...। নামটা বলতেই নীরা একটা বিদ্রুপের হাসিতে- ‘লালু ভুলু’ একটা গল্পের নাম হলো। ‘চুপচাপ মা অকস্মাৎ ফুঁসে উঠলেন’... হীরক রাজার দেশে, পথের পাঁচালি এগুলো তোমরা পড়েছো? বইয়ের স্তূপের ভিতর নীরার হাত থেকে জ্যামিতি বক্সটা পড়ে গেল। প্রথমদের বাড়ির টিভিতে এই দুইটা ছবি দেখেছে সে। কী মজার গল্প!
মা বলতেই থাকলেন, “জানো পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তেই এগুলো পড়া শেষ। ক্লাস এইটে শরৎচন্দ্র জসীমউদ্দীনও পড়া শেষ। ওগুলো তো তোমরা পড়বে না। সে বয়সে শুধু ‘শ্রীকান্ত’ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ পড়ার অনুমতি ছিল না।” আমার বাবা বলতেন, কলেজে ওঠো মিতুর মতো ওগুলো তোমারও পাঠ্য হবে। ‘তারপরও বইয়ের নিচে লুকিয়ে লুকিয়ে বড় আপার বইগুলো দু-চারপাতা পড়ে ফেলতাম।’
এখন পোলাপানরা কিছু জানতে চাইলেই গুগল খুলে বসে। নীরা অবাক বিস্ময়ে তাকালো এই বোকাসোকা কথা না বলা মা, এত তথ্য পান কোথায়?
নীরার মনোযোগ নেই দেখেই মা প্রসঙ্গ পাল্টালেন। ‘আগে তোমার বাবা কতো জাতের মাছ ধরতেন। চেলা, ট্যাংরা, বাতাসি, বউ মাছ, মলা, ঢেলা, বাইন, গুচি, খলশে, পুঁটি কত কী! ইছামতীর রূপাকলি জলের মতো চকচকে সব মাছ।’
নীরার গলাটা ধরে আসছে। মা বাবার স্মৃতিগুলো স্মরণে তাকে উসকে দিচ্ছে। আজ রমজানের শেষ দিন। আকাশে একফালি চাঁদ। শৈশবের কথা খুব মনে পড়ছে। বাবা নকিবুল মাস্টার বকবকে রসিক মানুষ। মায়ের ঠিক বিপরীত। বৈষয়িক চিন্তা মাথায় নিতে পারতেন না। শবেবরাত যেতে না যেতেই রোজা। রোজাভর কেনাকাটা। রোজার ঈদের পরের দিন থেকে গরু-ছাগলের ভাবনা। এসব কাণ্ডে ক্ষেপে মা গলায় শ্লেষ মাখিয়ে বলতেন, ‘পাছায় নাই চাম হরিকেষ্টের নাম।’ অথচ বাবা কথার চমকে সব সময় একটা উৎসবমুখর পরিবেশ ধরে রাখতেন। ঈদের দিন সকালে সালামি দিতে কীই না দরকষাকষি। মাছের হাটে ঝুড়ি ডাকে তোলার মতো হুল্লোড় কাণ্ড। সঙ্গে ছোট মামাও যোগ দিতেন। বড় মামার চোখ রাঙানি না খাওয়া পর্যন্ত কেউ থামতেন না। রাতভর মামাতো খালাতো ভাইবোনেরা ঈদ পার্বণী নিয়ে হিসাবনিকাশ কল্পনা-জল্পনা করত। দুই বছর হলো সে হিসাবও আর মেলাতে হয় না। বাবার সঙ্গে মামাও চলে গেছেন।
অনার্স সেমিস্টারের পর বরাবরই সপ্তাহখানিক ছুটি থাকে প্রথমের। ঈদের ছুটি ও পহেলা বৈশাখ সব মিলিয়ে ফোর্থ ইয়ার শেষ সেমিস্টারে ১০-১৫ দিন ক্লাস বিরতি এবার। বাবার দূরসম্পর্কে চাচাতো ভাইয়ের ছেলে প্রথম। বাবা বেঁচে থাকতে তার সঙ্গে মায়ের খুব একটা কথা হয়নি। এক দিন বাবা মারা যাওয়ার পর প্রথমের হাত ধরে মা বললেন, ‘ছুটিছাটা হলে ওর ইংরেজি আর অঙ্কটা একটু দেখো বাবা। উনার মৃত্যুর পর বখাটে ছেলেগুলোর উপদ্রবে মেয়েটি কোচিং ও কলেজে যায় না। শুধু পরীক্ষায় বসে। পড়াশোনার কী হাল জানি না।’
প্রাথমিকে পাঠের সময়ই প্রথমের বাঁশি বাজানোর বাতিক। নীরাদের পুকুরপাড়ে বুড়ো জারুল গাছটির নিচে বসে বিগত দিনগুলোর মতো আজও বাঁশি বাজাচ্ছে প্রথম। সেই পুরোনো সুরটি যেন আরও করুণ। নীরার বাবার চলে যাওয়ার দিনটি স্মরণে এসেছে প্রথমের? নীরার মামা প্রথমের বাবার বন্ধু। প্রথমের বাবার কাছে নীরার একটা বিয়ের সম্বন্ধের কথা তিনি বলেছেন তাঁকে। সেটি কি শুনেছে ও?
গাছভরা বেগুনি জারুল ফুল! আরও বিরহ বেহাগ বাজছে বাঁশিতে! সন্ধেটা জারুলের কোলে ঢুকে পড়ছে।
নীরা প্রথমকে ভালোবাসে কি না জানে না। প্রথমের উপস্থিতি ওর অভিভাবকশূন্যতাকে খানিকটা পূরণ করে। প্রথম এলে করিম চাচার মালয়েশিয়া-ফেরত ছেলেটি নীরার পথ আগলে ধরে না। বাজে ছেলেগুলো শিস দেয় না।
প্রথমের বাবা ধনাঢ্য। মায়ের অনুশাসনে নীরাদের বাড়িতে তার আগমন-অবস্থান দুটোই সীমিত। নীরার প্রতিবন্ধী বড় বোন শুধু ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে, আর ছবি আঁকে। বাবা ওই শৈলীটুকু তাকে বড় কষ্ট করে রপ্ত করিয়েছিলেন। বাবা ওকে মহেশ ডাকতেন। সত্যি ও শরৎচন্দ্রের সেই মহেশ।
বাবা চলে যাওয়ার পর ও রাতদিন ছবি আঁকে। খাতায়, দেয়ালে, মেঝেতে, উঠোনে সবখানে। এমনকি নীরা ও নীতুর পড়ার বইগুলো ভরিয়ে ফেলে এঁকে এঁকে। বাড়িতে কেউ তাকে কিচ্ছুটি বলে না।
মন খারাপের দিনগুলো উইপোকার মতো অলক্ষে কুরে কুরে খায় সুখের পোশাক-আশাক, আসবাবপত্র সব, সবকিছু। এমনকি উৎসবের দিনগুলোও।
আনন্দের দিনগুলো ঠিক জোনাকি পোকার মতো। আলো দেয় ঠিকঠাক। চুপিচুপি ঝিকিমিকি জ্বলতেই থাকে।
মা এসে একটা ধাক্কা দিলেন, ‘তোর কী হয়েছে?’ এতক্ষণ অবচেতন মনে স্মৃতি-বিস্মৃতি ও ভবিতব্যর রাজ্য ঘুরে এলো সে। মা মনে হয়, তা আঁচ করতে পেরেছেন।
তিনি বাবার কাপড়ের আলমারিটা গোছাচ্ছিলেন। নীরাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ইস্ত্রি করা কাপড়গুলো উল্টিয়ে রাগস্বরে বলছিলেন, ‘যে মানুষটি নেই তার পোশাক-আশাক গুছিয়ে রেখে কী হবে বাপু? ওগুলো কাউকে দিলে তো তারা দোয়া করে। তুমিও তো জানো বাড়তি পোশাক ঘরে রাখতে নেই।’
কেন জানি নীরা ঝাঁঝিয়ে উঠলো, ‘ওগুলো কি খাবার চাচ্ছে? বাবাকে তো ফেলে এসেছো! ওগুলোও পুকুরে ফেলে দাও, সঙ্গে আমাকেও...!’
মা নিঃশব্দে গরুর গোবরের ঝুড়িখানা কাঁখে নিয়ে পুকুরপাড়ে অন্ধকার অভিমুখে, দৃষ্টির খানিকটা অন্তরালে চলে গেলেন। অনেক রাতে নীরাকে তার ঘরে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
রাত পোহালেই ঈদ...!!