গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী।
আজ শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে ‘ফ্যাসিবাদ আমলের গণমাধ্যমে পরিস্থিতি : আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি মো. শহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী। সম্মানিত অতিথি হিসেবে ছিলেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্যসচিব কাদের গনি চৌধুরী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, বিএফইউজের সাবেক সভাপতি এম আবদুল্লাহ, ডিইউজের সাবেক সভাপতি এলাহী নেওয়াজ খান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাকের হোসাইন, সরদার ফরিদ আহমেদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি আবু সালেহ আকন, বিএফইউজের সিনিয়র সহকারী মহাসচিব বাছির জামাল, বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম মহসিন ও সিনিয়র সাংবাদিক হাসনাত করিম পিন্টু প্রমুখ।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ডিইউজে'র সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম। মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আমার দেশ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ।
বিএফইউজের মহাসচিব কাদের গনি বলেন, সাংবাদিকতা হচ্ছে রাষ্ট্রের অন্যতম একটা ইন্দ্রিয়, যার মাধ্যমে দেশের মানুষ রাষ্ট্র সম্পর্কে ও দুনিয়া সম্পর্কে ধারণা নেয়। সুশাসন নিশ্চিত করতে সংবাদমাধ্যম পাহারাদারের ভূমিকা পালন করে। এজন্য গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ, আর সাংবাদিকদের বলা হয় অতন্দ্র প্রহরী। কিন্তু বিগত সরকারের সময়ে সেটা পালন করতে দেয়নি। আর আমরা সাংবাদিকরাও হাসিনা সরকারের পোষা কুকুর হয়ে গিয়েছিলাম।
তিনি বলেন, সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের প্রতিবাদে ও মুক্ত সাংবাদিকতার দাবিতে মাহমুদুর রহমান প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন। যার ফলে তার উপর অবর্ণীয় নির্যাতন নেমে আসে। সেদিন যদি সবাই পাশে দাঁড়াতেন তাহলে আজকে এতগুলো মানুষ খুন হতো না, আমাদের সন্তানদের রক্তে ঢাকার রাজপথ লাল হতো না। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট থেকে মহাফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচার থেকে মহাস্বৈরাচার বানানোর পেছনে বহুলাংশে আমাদের সাংবাদিকরা দায়ী ছিল।
তিনি বলেন, আজকে কোনো এক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, কিছু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বলুনতো সাংবাদিকরা অপরাধ করলে অপরাধ নয়, অন্যায় করলে অন্যায় নয়। যেসব সাংবাদিক ফ্যাসিবাদ সরকারকে সহায়তা করেছে, বলেছে এই ছাত্ররা জামায়াত-শিবির, তাদের গুলি করেন। তাদের আমি সাংবাদিক বলি কীভাবে, তাদের আমি কেবল খুনিদের সহযোগী বলতে চাই। তবে গণহারে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা আমরা মেনে নিতে পারি না। নির্দোষ কোনো সাংবাদিক যেন হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে সরকারকে সচেতন থাকতে হবে।
কাদের গনি বলেন, শেখ হাসিনা ভারত থেকে চুক্তি করে আসলো, সাংবাদিকরা শেখ হাসিনার প্রেস কনফারেন্সে গিয়ে ভারতের সাথে কী কী চুক্তি করে আসলেন, সেটা জানতে চাইলেন না। ভারতকে যা দিয়েছে আজীন মনে রাখতে হবে- কী কী দিলেন এসব নিয়ে প্রশ্ন করা হলো না। জানতে চাওয়া হলো না আয়না ঘর নিয়ে। উল্টো বললেন, আপনিতো আর বাংলাদেশের নেত্রী নন, আপনি এখন বিশ্ব নেত্রী, বিশ্বে নোবেল পুরস্কার অর্জনের একমাত্র দাবিদার আপনি! হায়রে দালালি! শেখ হাসিনার এসব সংবাদ সম্মেলনকে সংবাদ সম্মেলন বললে সংবাদ সম্মেলনের সংজ্ঞা পাল্টে যাবে। সেটা ছিল শেখ হাসিনার সংবর্ধনার সভা। আমাদের সে জায়গা থেকে ফিরে আসতে হবে। সাংবাদিকতা হচ্ছে সত্যের আরাধনা। সেখানে সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ হতে পারে না। সাংবাদিক হতে হলে শতভাগ সত্যটা লিখতে হয়। কিন্তু গত ১৫ বছর এদেশের সাংবাদিকরা সত্য লিখতে ও বলতে পারেনি। যেটা আমাদের মর্যাদাকে ম্লান করে দিয়েছে। এই জায়গা থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে হবে। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার জন্য আইন-আদালত ব্যবহার করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সংস্কার করলে সত্যিকার অর্থে সংস্কার করুন। যেটা জনগণ চায়, আমরা চাই। সাংবাদিকদের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে সত্যের সন্ধান করা। আর এটা করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিকদের জেলে যেতে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে। এটার বড় প্রমাণ মাহমুদুর রহমান। সাংবাদিকদের এই ঝুঁকিটুকু নিতে হবে, অসহায় আত্মসমর্পণ সাংবাদিকদের মানায় না। সাংবাদিকতার মূল মন্ত্র হচ্ছে মিথ্যার সাথে আপস করা যাবে না। সত্যের তরে দৈত্যের সাথে লড়াই করা হচ্ছে সাংবাদিকতা। কিন্তু আজকে সেই সাংবাদিকতা নেই। গত ১৬ বছরে কী হয়েছে সে জায়গা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
আমি মনে করি সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিরাপদ ও স্বাধীন পরিবেশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কর্মস্থলে কিন্তু আমরা সেই পরিবেশ পাইনি। অনেক সাংবাদিক ঠিকমতো বেতন-ভাতা পান না, নারী সাংবাদিকদের জন্য আলাদা ওয়াশরুম নেই, এই জায়গাগুলো আমাদের ঠিক করতে হবে। সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের জন্য আইন আছে, সেই কালো আইন অবিলম্বে বাতিল চাই। একইসঙ্গে সাংবাদিকদের জন্য একটা সুরক্ষা আইন চাই, যেটা সাংবাদিকদের ঘরে-বাইরে নিরাপত্তা দেবে। পাশাপাশি সাংবাদিকদের আর্থিক সুরক্ষার বিষয়টি রাষ্ট্রকে নিতে হবে। অপ-সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিএফইউজের মহাসচিব বলেন, সাংবাদিকদের জন্য নবম ওয়েজবোর্ড দরকার। ক্ষুধার্ত রেখে সাংবাদিকদের দিয়ে কাজ করানো যাবে না। বিশেষ করে অধিকাংশ মফস্বল সাংবাদিকদের বেতন দেয় না বড় বড় মিডিয়াগুলো। আপনারা পত্রিকা চালাবেন, মালিক হবেন, ব্যবসা করবেন সাংবাদিকদের বেতন দেবেন না, সেটাতো হতে পারে না। পত্রিকা চালাতে হলে সাংবাদিকদের বেতন দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের কোনো অবস্থানে আপস করা চলবে না। সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার গণমাধ্যমের প্রতি যে জনগণের অনাস্থা তৈরি হয়েছে সেটা ফিরিয়ে আনা। সেটা সম্ভব একমাত্র বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে। এজন্য তোষামোদ, আত্মসমর্পণ, সেটা বন্ধ করে যদি সত্য কথাটা লিখি তাহলে জনগণের আস্থা ফিরে আসবে।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ