নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা-সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের দেওয়া রায়ের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই বলে উল্লেখ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, অবসরে যাওয়ার পর কোনো বিচারপতির শপথের কার্যকারিতা থাকে না। শপথ না থাকলে কোনো বিচারপতি কোনো রায় দিতেও পারেন না, লিখতেও পারেন না। এমনকি রায়ে স্বাক্ষরও করতে পারেন না। ১৬তম ঢাকা ল রিপোর্টে (ডিএলআর) আপিল বিভাগের রায়ের সিদ্ধান্ত এটি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপির পক্ষে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের করা আপিল শুনানিতে তিনি এসব কথা বলেন। গতকাল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চে এ শুনানি হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে ষষ্ঠ দিনের শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন নেপালের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাউত। এদিন সর্বোচ্চ আদালতের বিচার কাজের শুরুতেই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ নেপালের প্রধান বিচারপতি ও তাঁর সঙ্গে আসা প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে নেপালের প্রধান বিচারপতিকে অভিবাদন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। এরপর শুরু হয় ত্রয়োদশ সংশোধনী রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি।
প্রথমে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। পরে আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন আপিল বিভাগ।
শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, কোনো রায় ঘোষণার পর ঘোষিত রায় পরিবর্তন করতে হলে রিভিউ (পুনর্বিবেচনার) আবেদন করতে হয় অথবা সব পক্ষকে অবহিত করতে হয়। কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের সংক্ষিপ্ত আদেশ ঘোষণার পর পূর্ণাঙ্গ রায়ে পরিবর্তন করা হয়েছে। রিভিউ না করে বা কোনো পক্ষকে না জানিয়ে ঘোষিত রায় পরিবর্তন করে ১৯৮৮ সালের আপিল বিভাগের রুলসের ১০ (১) ও (২) বিধিকে লঙ্ঘন করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। শুধু তাই নয়, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ এবং দেওয়ানি কার্যবিধিও লঙ্ঘন করেছেন।
তিনি বলেন, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সন্নিবেশিত করার মাধ্যমে বিএনপির নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকার (১৯৯৬ সালে) জনগণের ভোটাধিকার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন সুনিশ্চিত করেছিল। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন। সেই রায়ের ওপর ভিত্তি করে সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল, যা ইতোমধ্যে বাতিল ঘোষণা করেছেন হাই কোর্ট। জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী শুনানিতে আরও বলেন, ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে তুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যে কারণে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় আমাদের ফিরে আসা উচিত। সেই কারণে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক যে রায়টি দিয়েছিলেন, সেই রায়টি পুনর্বিবেচনা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে ফেরানো দরকার।
শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতির এক প্রশ্নে শুনানি করেন বিএনপি মহাসচিবের আরেক আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল ও জামায়াতের আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিকী। শুনানির পর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এ নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও রুহুল কুদ্দুস কাজল। সেখানে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট ইজ দ্য গার্ডিয়ান অব দ্য কনস্টিটিউশন (সুপ্রিম কোর্ট হচ্ছে সংবিধানের অভিভাবক)। অভিভাবকের ক্ষমতা অন্য কোথাও ভেস্ট (ন্যস্ত) করা যায় না। অভিভাবকের ক্ষমতা অভিভাবককেই প্রয়োগ করতে হয়। আর সুপ্রিম কোর্ট কোনো অবস্থাতেই তার ক্ষমতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ব্যবহার করতে পারেন না। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন। তার এই ব্যবহারের কারণেই যত হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, ভোট নিয়ে অনিশ্চয়তা। তাই আমারা আরজি জানিয়েছি, তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিলের রায় কোনো অবস্থাতেই থাকতে পারে না। যদি এ রায় থাকে তাহলে বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতা থাকে না।’
প্রধান বিচারপতির প্রশ্নে শুনানিতে কী বলেছেন, জানতে চাইলে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘আমরা বলেছি অবশ্যই এটি (রিভিউ, যা এখন আপিল হিসেবে শুনছেন সর্বোচ্চ আদালত) পুনর্বিবেচনা করতে হবে। দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে, আইনের শাসনের স্বার্থে এবং বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকারের স্বার্থে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্যই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।’
১৪ বছর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। পরে এ রায় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রায় পরিবর্তনের অভিযোগ ওঠে। জুলাই অভ্যুত্থানে গত বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৪ বছর আগের বিতর্কিত রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে গত বছর ২৭ আগস্ট আবেদন করেন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। পরে ১৭ অক্টোবর আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর পাঁচ দিন পর ২৩ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। এ ছাড়া আরেকটি আবেদন করেন নওগাঁর রানীনগরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন। এরপর আরও দুটি আবেদন করা হয়। রিভিউ আবেদনে আপিল করার অনুমতি দিয়ে আপিল শুনানি হবে, নাকি রিভিউ আবেদনেই চূড়ান্ত শুনানি হবে, এ নিয়ে দুই দিন শুনানির পর গত ২৭ আগস্ট সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত জানান। ছয়টি আবেদনের মধ্যে একটি আবেদনে আপিলের অনুমতি দিয়ে চারটি আবেদন এর সঙ্গে যুক্ত করে দেন আপিল বিভাগ। অন্য আবেদনটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়ে শুনানির জন্য রেখেছিলেন সর্বোচ্চ আদালত। সেই ধারাবাহিকতায় গত ২১ আগস্ট শুনানি শুরু হয়।