২০১৮ সালের নির্বাচনে জাহাঙ্গীর কবির নানককে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তাঁর মতো হেভিওয়েট নেতা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কেন পেলেন না, এ নিয়ে বিভিন্নমুখী আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলার কারণে নানকের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করেছিল মার্কিন দূতাবাস। সম্ভবত মার্কিন চাপেই শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত নানককে মনোনয়ন দেননি। তবে মনোনয়ন না দিলেও খুব শিগগিরই নানক পুরস্কৃত হন। তাঁকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থেকে প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ওই সময় মোহাম্মদপুরে মনোনয়ন পান সাদেক খান। ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচনের পর অনেকে মনে করেছিল নানকের রাজনৈতিক অধ্যায়ের অবসান ঘটবে। মোহাম্মদপুরে নানকের দুর্নীতি এবং লুণ্ঠন অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, জাহাঙ্গীর কবির নানক প্রমাণ করে দিয়েছিলেন কিছু না থেকেও একজন মানুষ যদি দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্ত হয় তাহলে তিনি যেখান থেকে যেভাবে ইচ্ছা দুর্নীতি করতে পারেন। নানক প্রসঙ্গে প্রয়াত সৈয়দ আশরাফ একটি গল্প বলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে সেই গল্পটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত। সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, ‘একজন সরকারি কর্মচারী, তাকে যেখানেই বদলি করা হয়, সেখানেই তিনি দুর্নীতি করেন। এ রকম ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ যখন তার বিরুদ্ধে উঠল, তখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার ওপর ক্ষুব্ধ হলেন। ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন তাকে এমন এক জায়গায় বদলি করে দাও যেখানে ঘুষ খাওয়ার কোনো পথ নেই। সবাই মিলে পরামর্শ করে তাকে নদী এলাকায় বদলি করে দিলেন। সেখানে তার কাজ হলো চেয়ার-টেবিল বসিয়ে নদীর ঢেউ গণনা করা। সবাই মনে করল এখন তার আর ঘুষ খাওয়ার কোনো পথ নেই। নদীর ঢেউ গুনে তো আর উপরি আয় হবে না। কিন্তু যিনি দুর্নীতি করেন, তিনি জানেন কীভাবে দুর্নীতি করতে হয়। যে কোনো জায়গায়, যে কোনো পরিস্থিতিতে তিনি দুর্নীতি করেন। কদিন পর ট্রলার মালিক, লঞ্চ মালিক, ফেরির মালিকরা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে গিয়ে আকুল আবেদন করল যেন ওই ব্যক্তিকে ওখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তো হতবাক। তারা জানতে চাইলেন, তার তো কোনো কাজ নেই। তাকে দেওয়া হয়েছে ঢেউ গণনার জন্য। সেখান থেকে অর্থ উপার্জনের কোনো উপায় নেই। তখন নৌযান মালিকরা বললেন, ওই কর্মকর্তা চলাচলে বাধা দিচ্ছেন। নৌযান চলাচল করলে তার ঢেউ গণনার সমস্যা হয়। এ অভিযোগে তিনি আমাদের নৌযান চলাচলে বাধা দিচ্ছেন। টাকা দিলেই তবে নৌযান চলাচল করতে দিচ্ছেন। এভাবে টাকা দেওয়া তো সম্ভব নয়।
জাহাঙ্গীর কবির নানক ছিলেন এই প্রজাতির। তিনি ২০০৯ সালে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বেশুমার দুর্নীতি করেছেন। প্রতিমন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। ২০১৪ সালে এমপি থেকে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তিনি মন্ত্রী-এমপি কিছুই নন। কিন্তু দুর্নীতি থেকে তাঁকে রুখবে কে? নানক যেখানেই যাবেন সেখানেই দুর্নীতির নিত্যনতুন পথ আবিষ্কার করবেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হওয়ার পরপরই তিনি শুরু করলেন কমিটি বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্য। একের পর এক কমিটি এবং মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট শুরু করলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরই স্থানীয় সরকার নির্বাচন শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচন হবে। সে অনুযায়ী দলের ভিতর শুরু হয়ে যায় অবাধ মনোনয়ন বাণিজ্য। যে যেভাবে পেরেছেন, লুটপাট করে অর্থ গ্রহণ করেছেন। এ সময় যেহেতু বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা এ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না, সে রকম বাস্তবতার বিবেচনায় আওয়ামী লীগের মধ্যে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছিল যে যারাই মনোনয়ন পাবেন, তারাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান বা পৌরসভার মেয়র হিসেবে আপনাআপনি নির্বাচিত হবেন। জনগণের ভোট প্রাপ্তি কোনো বিষয় নয়। আর এ রকম বাস্তবতায় জাহাঙ্গীর কবির নানকের জন্য সৃষ্টি হয় একটি সুবর্ণ সুযোগ। তিনি যেন এক স্বর্ণভান্ডারের সন্ধান পান। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিও ১ কোটি টাকা দিতে রাজি হন। আওয়ামী লীগের নেতারা জানতেন শুধু একজনকে টাকা দিলে হবে না। মনোনয়ন বোর্ডের অন্য সদস্যদেরও টাকা দিতে হবে। আর সে কারণেই মনোনয়ন বোর্ডের যাঁরা সদস্য, তাঁদের সবাইকে অর্থ দেওয়া শুরু করেন। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়ার কারণে শেখ হাসিনা নানককে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য করেছিলেন। এ সদস্য হওয়ার কারণে নানককে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি অবাধে মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন।
শুধু মনোনয়ন বাণিজ্য করেই ক্ষান্ত হননি। এ সময় বিভিন্ন কমিটির নতুন সম্মেলনের আয়োজন শুরু করা হয়। সম্মেলনের পর জেলা পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। যেহেতু নানক, বাহাউদ্দিন নাছিম, আবদুর রহমানসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি, সেহেতু শেখ হাসিনা কমিটি গঠন করার জন্য বিশেষভাবে তাঁদের দায়িত্ব দেন। আর এ সুযোগে তাঁরা শুরু করেন কমিটি বাণিজ্যের সিন্ডিকেট। ‘টাকা যার কমিটি তার’ এ নীতি চালু করেন। আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া লুটেরা কোটিপতি, যারা হাইব্রিড আওয়ামী লীগ হিসেবে পরিচিত, বিভিন্ন ব্যবসাবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত, যারা আওয়ামী লীগে এসেছেন দুর্নীতি-লুটপাট করার জন্য, নিজেদের অবৈধ ব্যবসার বৈধতা দেওয়ার জন্য; তারা নানকের সিন্ডিকেটের কাছে কোটি কোটি টাকা দিয়ে কমিটির অনুমোদন নেন। অনেকেই মনে করেন আওয়ামী লীগ ধ্বংসের সূচনা হয়েছিল এ কমিটি বাণিজ্যের মাধ্যমে। দলের সঙ্গে সম্পৃক্তহীন, কোনো দিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না এ রকম ব্যক্তিরাও আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঢোকেন। ফলে আওয়ামী লীগের কমিটি অকার্যকর হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের কমিটি অকার্যকর হলে কী হবে? জাহাঙ্গীর কবির নানক ফুলেফেঁপে ওঠেন। তাঁর বিত্তবৈভব আরও বাড়তে থাকে। এ সময় তিনি এমপি-মন্ত্রী নন বিধায় কারও নজরদারির মধ্যে ছিলেন না। গণমাধ্যম বা সরকার কেউই তাঁর দিকে দৃষ্টি রাখেনি, ফলে নানক বেপরোয়া লুণ্ঠন এবং লুটপাট শুরু করেন। একাধিক সূত্র বলছেন, এ সময় নানক বিদেশে বিনিয়োগ শুরু করেন। ইতোমধ্যে নানকের বড় ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যু বরণ করেন। লন্ডনে অবস্থানরত নানকের মেয়ে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে দেশে ফিরে আসেন। এরপর তাঁর মেয়ে রাখি নানকের এসব অবৈধ লুণ্ঠন তদারকি শুরু করেন। রাখির তত্ত্বাবধানে এবার লুটের টাকায় নানক বিদেশে বিনিয়োগ শুরু করেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা যেমন লন্ডন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছেন, নানক সে পথে যাননি, বরং নানক তাঁর অবৈধ অর্থের একটি বড় অংশ বিনিয়োগ করেছেন ভারতে। যোগাযোগের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে তিনি অর্থ পাঠিয়েছেন। সেই অর্থ বেনামে ভারতে বিনিয়োগ হয়েছে। কাগজে কলমে নানকের কোনো সম্পদ সেখানে নেই। তাঁকে ধরারও উপায় নেই। কিন্তু এই ব্যবসায়ীরা মাসে মাসে নানককে লভ্যাংশের টাকা দেন। উল্লেখ্য, এখন কলকাতার নিউটাউনে নানক যে বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন, সেটি তাঁর কেনা। বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ লুটপাট করে তিনি পাঠিয়েছেন, সেই অর্থ থেকেই তিনি বাড়িটি কিনেছেন বলে জানা গেছে। নানক হলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সেই ধুরন্ধর ব্যক্তি, যিনি বিপুল অর্থসম্পদ বানিয়েছেন কিন্তু কাগজে কলমে তাঁর কোনো কিছুই নাই। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নানকের বেশ কিছু বিশ্বস্ত অনুসারী এবং ক্যাডার রয়েছে। তিনি সব সময় ক্যাডার পরিবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করতেন। জমিজমা, টাকাপয়সা সবকিছুই তিনি তাঁর ক্যাডারদের নামে রাখতেন। নিজের নামে কিছুই রাখতেন না। যার কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন যখন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে তখন দেখা যাচ্ছে তাঁর অর্থসম্পদের পরিমাণ খুব সামান্য। কিন্তু গত ১৫ বছরে নানক প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করেছেন। মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডির অলিগলিতে রয়েছে নানকের সম্পদ। স্থানীয় মানুষ জানে এসব সম্পদের মালিক নানক। কিন্তু তাঁকে আইনের দৃষ্টিতে ধরা, তাঁর মালিকানা প্রমাণ করা দুরূহ কাজ।