বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি সপ্তাহেই পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এরই মধ্যে একীভূতকরণের সব প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হয়েছে। এখন শুধু ব্যাংকগুলোর শেষবারের মতো ব্যাখ্যা শোনার পরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। আগামী রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাঁচটি ব্যাংকের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেখানে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি, তারল্য সংকট, খেলাপি ঋণ, সিআরআর ও প্রভিশন শর্টফলের সর্বশেষ তথ্য নিয়ে শুনানিতে অংশ নিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি কেন তাদের একীভূত করা হবে না, সে ব্যাখ্যাও দিতে বলা হয়েছে।
তবে একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক্সিম ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকেই নিজেদের বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। এ বিষয়ে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানসহ ৯ জন শেয়ারহোল্ডার গভর্নর ও অর্থ বিভাগের সচিব বরাবর চিঠি দিয়েছেন।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, মুখের কথায় বা অযৌক্তিক আবদারে মার্জার ঠেকানো যাবে না। ক্যামেলস রেটিং, খেলাপি আদায়, এডিআর, ধার পরিশোধসহ বিভিন্ন আর্থিক সূচকে দৃশ্যমান উন্নতি ঘটাতে না পারলে ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত করা হবে। ধার করে টিকে থাকা এবং আগের ধারও পরিশোধে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোকে আর কোনো তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে না। কিন্তু গত এক বছরে এই পাঁচটি ব্যাংকের কেউই এসব সূচকে সন্তোষজনক উন্নতি করতে পারেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করতে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৫ হাজার কোটি টাকা মূলধন বিনিয়োগ হিসেবে সরকারের কাছে চাওয়া হয়েছে। আর বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা আমানত বীমা ট্রাস্ট তহবিল থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের প্রক্রিয়াও চলছে।
সরকারি অনুমোদন পেলে নতুন ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স ইস্যু হবে এবং আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে এটি সরকারি ব্যাংক হিসেবে পরিচালিত হবে। পরিচালনা পর্ষদে ইসলামী ব্যাংকিং, আর্থিক খাত, আইটি ও আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এরপর পর্ষদের মাধ্যমে একজন অভিজ্ঞ এমডি নিয়োগ দেওয়া হবে।
এদিকে একীভূতকরণের ফলে একই এলাকায় একাধিক শাখা থাকায় কর্মী ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, গণহারে কর্মী ছাঁটাই না করে গ্রামীণ এলাকায় নতুন শাখা খোলা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পাঁচটি ব্যাংকের আমানত ধারাবাহিকভাবে কমে মে মাসে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকায়। অন্যদিকে ঋণস্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৯৫ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। ফলে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৭ শতাংশ।
ব্যাংকভিত্তিক খেলাপির চিত্র ভয়াবহ। ইউনিয়ন ব্যাংকে ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৯৫ শতাংশ, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে ৬২ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকে ৪৮ শতাংশ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এসব ব্যাংক এরই মধ্যে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ ধারও নিয়েছে।
সব শেষে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, এই সপ্তাহের শুনানি শেষে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে নতুন ব্যাংক গঠনের ঘোষণা আসতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র বলেন, বেসরকারি খাতের পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে শিগগিরই একীভূত করা হবে। একত্র হলেও এসব ব্যাংকের কর্মীরা চাকরি হারাবেন না। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোতে আস্থা ফেরাতে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এগুলোকে একত্রকরণ নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। খুব শিগগিরই আসতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে এখন পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে সংকট সামাল দেওয়া গেছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান পুরোপুরি হয়নি। ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে দিয়ে লুটপাট বন্ধ করা গেছে। অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেওয়ার পথ বন্ধ করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের পতনও থেমেছে।
ব্যাংক খাতে এখন দ্রুততম সময়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করতে হবে। গ্রাহকের আস্থা বাড়াতে হবে। কারণ গ্রাহকের আস্থাই ব্যাংক খাতের বড় সম্পদ। কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবা যায়। যেসব ব্যাংকে সমস্যা আছে, যেগুলোর ঘুরে দাঁড়ানো বা গ্রাহকের চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা নেই, সেগুলোর ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্ত হতে পারে অবস্থা বুঝে একীভূতকরণ (মার্জার) অথবা লিকুইডিশন (বন্ধ করে দেওয়া)। কারণ এসব ব্যাংক যত দিন থাকবে, যত দিন গ্রাহকের অর্থ দিতে পারবে না, তত দিন আস্থাহীনতা বাড়বে। ধীরে ধীরে ভালো ব্যাংকগুলোতেও এর প্রভাব পড়বে। কাজেই এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে এসব ব্যাংক এই অবস্থায় থাকবে নাকি বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন বলেন, ‘দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৫ শতাংশই লেনদেন হয় এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে। তাই দুই বছর সময় দিলে ব্যাংকটি শতভাগ ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমরা আশাবাদী।’
শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক একীভূতকরণের আনুষ্ঠানিকতায় গতকাল (রবিবার ৩১ আগস্ট) এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে বৈঠকের কথা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের। তবে অসুস্থ থাকায় গভর্নর বৈঠকে উপস্থিত হতে পারেননি। ফলে সকাল থেকে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করার পর চলে যান এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা।
বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সময় দিলে আগামীকাল কিংবা পরশু আবার বৈঠক হবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংক ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। বিশাল গ্রাহকভিত্তি থাকার কারণে সামনে আরো ইতিবাচক অগ্রগতি হবে।’
এদিকে সভার সূচি অনুযায়ী, আজ সোমবার গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
বিডি প্রতিদিন/নাজিম