সমাজের ধনাট্য ব্যক্তির সন্তানদের পাশাপাশি মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের স্বপ্নের বাহন এখন মোটরসাইকেল। গতিময় মোটরসাইকেল চালানো কারও কারও স্টাইল ও ফ্যাশনেও পরিণত হয়েছে। আবার এ বাহনটি চালিয়ে অনেকে জীবিকানির্বাহ করছেন, অনেকে পরিবারের হাল ধরেছেন, আবার অনেকে নিজেদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক কর্মজীবী মানুষও যানজটের শহরে মোটরসাইকেলে চলাফেরাকে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় মনে করছেন। এ ছাড়া তীব্র যানজটের কারণে অনেকেই দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহার করছেন মোটরসাইকেল।
কিন্তু সারা দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। অনেকে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, বয়ে বেড়াচ্ছেন দুর্বিষহ জীবন। কেউ হারিয়েছেন পা, আবার কেউ হারিয়েছেন হাত। কেউ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শুধু নিজে যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন না, পরিবারের স্বাভাবিক জীবনে হয়ে উঠেছেন বোঝা। এতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের বাবা-মাসহ স্ত্রী-সন্তানদের জীবন তছনছ হচ্ছে। অনেকে ছিলেন একমাত্র উপার্জনকারী, আবার অনেকে ছিলেন মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন। তাদের মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব সেসব পরিবারের স্বপ্ন বা জীবনকে তছনছ করে দেয়। একটি দুর্ঘটনার ফলে আনন্দ এবং স্বপ্নের বাহন মোটরসাইকেল হয়ে যায় দুঃস্বপ্ন ও দুঃখের কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোটরসাইকেলের ব্যাপক উপস্থিতি। অন্য যানবাহনের জন্য রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মোটরসাইকেল। অনেকে স্টাইল করে নিজের আধিপত্য জানান দিতে, কেউবা প্রেমিকা বা কাছের লোককে দেখাতে, কেউ দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটছেন। অকালে প্রাণ ঝরছে অনেকের। এতে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বাড়ছে। এটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করলে হতাহতের সংখ্যা কমে আসবে। এ বিষয়ে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য সেক্টরের রোড সেফটি প্রকল্পের সমন্বয়কারী শারমিন রহমান বলেন, মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতিই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা নিজেদের আধুনিক ও স্মার্ট হিসেবে উপস্থাপন করতে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে এবং দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এজন্য সড়কে চলাচল করা প্রত্যেকটি যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোর ও যুবক। এদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার বিষয়টি প্রবল। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় পড়ছে এবং অন্যদেরও ফেলছে। সড়কে গণপরিবহনসহ কোনো যানবাহনের শৃঙ্খলা নেই। একই সড়কে সব গতির গাড়ি চলছে। ফলে যানবাহনের বেপরোয়া গতি এবং পথচারীদের অসচেতনতার কারণে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি জানান, মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সারা দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা একটা ঝুঁকিপূর্ণ বাহন। ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালানো হচ্ছে। এ বাহনের বেশির ভাগ চালকই অল্প বয়সের। অনেক মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী হেলমেট পরছেন না। এসব কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এবং হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিং এবং অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। বেপরোয়া গতিরোধ এবং সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। হাইওয়ে পুলিশ স্পিড গানের ব্যবহার করে গতি নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা ড্রাইভিং লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন ও ট্যাক্স টোকেন নিয়মিত চেক করছি, সমস্যা থাকলে ব্যবস্থা নিচ্ছি। গত ১২ এপ্রিল সকালে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল এলাকায় কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কে বাসচাপায় মোটরসাইকেলের দুই আরোহী নয়ন ইসলাম (২৫) ও রনি ইসলাম (২৬) নিহত হন। এ সময় আহত হন মিজানুর রহমান (২৭) নামে একজন। জানা গেছে, হতাহতরা সবাই সদর উপজেলার উজানগ্রাম ইউনিয়নের দূর্বাচারা গ্রামের বাসিন্দা। তারা কিয়াম মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজে চাকরি করতেন। নিজ দূর্বাচারা গ্রাম থেকে একটি মোটরসাইকেলে কর্মস্থলে যাওয়ার সময় এ দুর্ঘটনার শিকার হন। তাদের পরিবারে এখন শুধুই হাহাকার।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৩৩ জন, যা মোট প্রাণহানির ৩৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ঈদযাত্রা শুরুর দিন ২৪ মার্চ থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ দিনে ১৩৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫১ জন নিহত ও ১৫৫ জন আহত হয়েছেন। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪২.৮৫ শতাংশ।