কোরআন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক আল্লাহ তাআলার নাজিলকৃত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি গ্রন্থ। কোরআনের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, অপূর্ব ধ্বনি ব্যঞ্জনা, শব্দের লালিত্য, বর্ণনার বলিষ্ঠতা, প্রকাশভঙ্গির প্রাঞ্জলতা, রসবোধ ইত্যাদি গুণ আরবপণ্ডিতদের ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। ড. মরিস বুকাইলির ভাষায়, কোরআন বিজ্ঞানের জন্য একটি বিজ্ঞান গ্রন্থ, ভাষাবিদদের জন্য একটি শব্দকোষ, ব্যাকরণবিদদের জন্য একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ, কবিদের জন্য একটি ছন্দ সংহিতা এবং আইনজ্ঞদের জন্য একটি আইন গ্রন্থ।
কোরআনের মৌলিক আলোচ্য বিষয়
কোরআন মাজিদে পাঁচ ধরনের বিষয় আলোচিত হয়েছে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, কোরআন পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। ১. হালাল, ২. হারাম, ৩. মুহকাম, ৪. মুতাশাবিহ ও ৫ আমসাল বা উপমা। অতএব, তোমরা হালালগুলো মেনে চলো, হারাম থেকে বিরত থাকো, মুহকামের অনুসরণ করো, মুতাশাবিহের প্রতি বিশ্বাস রাখো এবং আমসাল বা উপমা থেকে উপদেশ গ্রহণ করো। (বায়হাকি)
১. হালাল : হালাল হলো ওই সব নির্দেশিকাসংবলিত আয়াত, যেগুলোর মধ্যে করণীয় কাজের আদেশ করা হয়েছে।
এগুলো চার ভাগে বিভক্ত। ক. ঈমান ও আমল বিষয়ক, খ. অন্যের হক ও অধিকার বিষয়ক, গ. আখলাক ও নৈতিকতা বিষয়ক, ঘ. আদব ও শিষ্টাচার বিষয়ক।
২. হারাম : হারাম হলো যেসব কাজ করতে আল্লাহ তাআলাা নিষেধ করেছেন। কোরআনে হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলোকে বিভিন্ন গুণবাচক শব্দ ব্যবহার করে বোঝানো হয়েছে।
যেমন—মুনকার বা অসৎ কাজ। ফাহশা বা অশ্লীলতা, সাইয়্যিয়া বা মন্দকর্ম, খতা বা ভুল, অপছন্দনীয়, মাকরুহ বা ত্রুটি, ইছম বা পাপ, উদওয়ান বা বাড়াবাড়ি ইত্যাদি। হারাম বা নিষিদ্ধ কাজগুলো প্রধানত দুই প্রকার। যথা—কবিরা ও সগিরা।
হালাল বা আদিষ্ট কাজগুলো সাধ্যমতো করতে হবে।
আর হারাম ও নিষিদ্ধ কাজগুলো
সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে।
৩. মুহকাম : মুহকাম অর্থ সুস্পষ্ট, বোধগম্য, মজবুত ইত্যাদি। মুহকাম আয়াতকে আল্লাহ তাআলা উম্মুল কিতাব তথা কোরআনের আসল (মূল) বিষয় বলেছেন। কেননা এসব আয়াত আসমানি শিক্ষার মূল ভিত্তি।
৪. মুতাশাবিহ : মুতাশাবিহ অর্থ অস্পষ্ট ও
রূপক। যেমন—কিয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, দাজ্জাল বের হওয়ার কথা, কোরআন মাজিদের সুরার প্রথমে বর্ণিত বিচ্ছিন্ন অক্ষর ইত্যাদি। এসব আয়াতের উদ্দেশ্য অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। এগুলো আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর মধ্যকার গোপন রহস্য। এগুলোর প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে সর্বসাধারণ অবগত হতে পারে না; বরং এসব শব্দের তথ্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া বৈধ নয়। এগুলোর মমার্থ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না, তবে না জানলেও এগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ফরজ। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তিনি আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের মূল। আর অন্যগুলো
রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে তারা এর রূপকগুলোর অনুসরণ করে ফিতনা বিস্তার ও অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৭)
৫. আমসাল : আমসাল শব্দটি মাসাল-এর বহুবচন। এর অর্থ উপমা, উদাহরণ, প্রবচন, আদর্শ, সদৃশ, নিদর্শন, দৃষ্টান্ত ইত্যাদি। আল-মাওয়ারদি (রহ.) বলেন, উপমা কোরআনের অন্যতম বৃহৎ অংশ, অথচ মানুষ তা থেকে সম্পূর্ণ উদাসীন। মানুষ এগুলোর নিগূঢ় অর্থ বুঝে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছে না। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, উলুমুল কোরআন সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা কোরআন গবেষকের জন্য ওয়াজিব।
উপমার উদাহরণ
১. ‘আল্লাহ তাআলা নিঃসন্দেহে মশা বা তদূর্ধ্ব বস্তু দ্বারা উপমা উপস্থাপনে লজ্জাবোধ করেন না।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৬)
২. ‘আর কাফিরদের উদাহরণ এমন, যেন কেউ এমন কোনো জীবকে আহ্বান করছে, যা হাঁকডাক আর চিৎকার ছাড়া কিছুই শুনে না।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৭১)
৩. ‘আপনি তাদের কাছে সে জনপদের অধিবাসীদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করুন, যখন সেখানে রাসুলরা আগমন করেছিলেন।’
(সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ১৩)
কোরআনে মোট ১৭৯টি উপমা রয়েছে (মুজামুল মুফহারিস লি আলফাজিল কোরআন, মুহাম্মদ ফুআদ আবদুল বাকী)।
এসব উপমা ও উদাহরণের উপকারিতা হলো, উপদেশ দান, উৎসাহিত করা, ভীতি প্রদর্শন, দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা, আসল ভাব উদ্ধার করা, মূল বিষয়ের প্রতিচ্ছবি চিত্রিত করা ইত্যাদি। তা ছাড়া কোরআনের উপমাগুলো প্রশংসা, নিন্দা, বিনিময়, শক্তি, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা কিংবা তুচ্ছ করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন