ঈমানের পর মুসলমানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো নামাজ। মুসলমানের জন্য সর্বাবস্থায় নামাজ আদায় করা ফরজ। কারাগারে বন্দি ব্যক্তিও নামাজের বিধানের বাইরে নয়। আলোচ্য প্রবন্ধে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো।
নামাজ সর্বাবস্থায় ফরজ
নামাজ শরিয়তের এমন একটি বিধান, যা সর্বাবস্থায় মুকাল্লাফ (শরিয়তের বিধান প্রযোজ্য এমন) ব্যক্তির ওপর ফরজ। চাই সে সুস্থ হোক বা অসুস্থ, নিরাপদে থাকুক বা বিপদগ্রস্ত, বাড়িতে থাকুক বা সফরে, নিরাপদে থাকুক বা যুদ্ধে। ব্যক্তির যতক্ষণ হুঁশ-জ্ঞান ঠিক থাকে ততক্ষণ তার জন্য নামাজ আদায় করা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নামাজের প্রতি যত্নবান হবে, বিশেষত মধ্যবর্তী নামাজের এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে; যদি তোমরা আশঙ্কা করো তবে পদচারী অথবা আরোহী অবস্থায় নামাজ আদায় করবে।
আর যখন তোমরা নিরাপদ বোধ করো তখন আল্লাহকে স্মরণ করবে, যেভাবে তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা তোমরা জানতে না।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৩৮-২৩৯)
ইমরান ইবনুল হুসাইন (রা.) বলেন, ‘আমার পাঁজরে ব্যথাজনিত রোগ ছিল। আমি নবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে, তাতে সক্ষম না হলে বসে আদায় করবে এবং তাতেও সক্ষম না হলে শুয়ে সালাত আদায় করবে।’
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৯৫২)
বন্দি ব্যক্তির নামাজের বিধান
শরিয়তের আলোকে বন্দি ব্যক্তির নামাজের বিধান বর্ণনা করা হলো—
১. অজু, কিবলা ও দাঁড়ানোর বিধান : ফকিহ আলেমরা বলেন, অপারগতার সময় নামাজের শর্ত ও রোকনগুলো স্থগিত হয়ে যায়।
কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘তিনি তোমাদের মনোনীত করেছেন। তিনি দ্বিনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৭৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি যখন তোমাদের কোনো বিষয়ে আদেশ দিই, তখন তোমরা সাধ্যানুযায়ী তা আদায় করবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭২৮৮)
সুতরাং কেউ যদি জেলে কিবলা নির্ধারণ করতে না পারে, তবে সে মনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে যেকোনো দিকে নামাজ আদায় করবে। দাঁড়াতে না পারলে বসে এবং বসে না পারলে ইশারায় নামাজ আদায় করবে।
কেউ পানি ব্যবহার করে পবিত্রতা অর্জনের সুযোগ না পেলে তায়াম্মুম করবে। বন্দি ব্যক্তি যদি অজু বা তায়াম্মুম কোনোটার সুযোগ না পায়, তবে হানাফি মাজহাব অনুসারে নামাজের সাদৃশ্য অনুসরণ করে পূর্ণ নামাজ আদায় করবে। পরবর্তী সময়ে সুযোগ পেলে আবার নামাজ পড়ে নেবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/৩৪৩; রদ্দুল মুহতার : ১/২৪৩)
২. কসরের বিধান : আটক ব্যক্তিকে যদি নিজ শহরে বন্দি রাখা হয়, তবে সে মুকিম ব্যক্তির মতো পূর্ণ নামাজ আদায় করবে। চাই তাকে যত অল্প সময়ের জন্য বন্দি করা হোক না কেন। আর তাকে যদি সফর পরিমাণ দূরত্বে তথা ৪৮ মাইল দূরের কোনো স্থানে ১৫ দিনের কম সময়ের জন্য বন্দি রাখা হয়, তবে সে কসর আদায় করবে। যে বন্দি তার জেলজীবনের মেয়াদ সম্পর্কে জানে না, সে তার প্রবল ধারণা অনুযায়ী আমল করবে। অর্থাত্ যদি তার ধারণা হয়, ১৫ দিনের কম সময়ে মুক্তি বা জামিন পাবে, সে কসর পড়বে। আর এর থেকে অধিক সময় বন্দি থাকার সম্ভাবনা থাকলে মুকিমের মতো নামাজ আদায় করবে। (আদ দুররুল মুখতার : ২/১৩২)
৩. জুমা ও ঈদের নামাজ : বন্দি ব্যক্তির ওপর জুমা ও ঈদের নামাজ ওয়াজিব নয়। সে জেলে জুমার পরিবর্তে জোহরের নামাজ আদায় করবে। তবে জেলখানায় যদি জুমা ও ঈদের নামাজের ব্যবস্থা করা হয়, তবে বন্দি ব্যক্তির তাতে অংশ নেওয়ার অবকাশ আছে। জেলখানায় অনুষ্ঠিত জুমা ও ঈদের নামাজে অংশ না নেওয়ারও অবকাশ আছে। তবে অংশ নেওয়াটাই উত্তম। (আদ দুরার আমার রদ : ১/২৮ ও ৩২ এবং ২/১০০)
তবে বন্দি ব্যক্তি সামর্থ্যবান (শরয়ি নিসাবের মালিক) ও মুকিম হলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। সে চাইলে জেলখানা বা তার বাইরে কোরবানি করতে পারবে। একইভাবে বন্দি ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব, যা সে জেলের ভেতরে বা বাইরে হকদার ব্যক্তিকে অর্পণ করতে পারবে। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩১২)
৪. বন্দি ব্যক্তির ইমামতি : বন্দিত্ব ইমামতির জন্য কোনো বাধা নয়। জেলে বন্দি ব্যক্তি বন্দি ও মুক্ত উভয় শ্রেণির মানুষের ইমামতি করতে পারবে। কোনো বন্দি ইমামতি করলে জেলখানার কর্মীরা তার পেছনে নামাজ আদায় করতে পারবে। শর্ত হলো তার ভেতরে ইমামতির শর্তগুলো বিদ্যমান থাকা। তা হলো নামাজের মাসলা-মাসায়েল জানা, কোরআন তিলাওয়াত শুদ্ধ থাকা, প্রকাশ্য কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। ধারাবাহিকভাবে এসব বিষয়ে যে যত বেশি অগ্রগামী হবে সে ইমামতির জন্য তত বেশি যোগ্য বিবেচিত হবে। (ফাতাওয়া শামি : ১/৫৫৭)
তবে জেলখানায় যদি কোনো ইমাম নিযুক্ত থাকেন এবং তাঁর ভেতরে ইমামতির গুণাবলি পাওয়া যায়, তবে নির্ধারিত ইমামই নামাজের ইমামতি করবেন। কেননা শরিয়তের আলোকে মসজিদের নির্ধারিত ইমামই ইমামতির হকদার। তাই ইমামতির উপযুক্ত নির্ধারিত ইমামের উপস্থিতিতে তাঁর অনুমতি ছাড়া অন্য কারো ইমামতি করা শরিয়তসম্মত নয়। অনুমতিবিহীন ইমামতি করলে নামাজ আদায় হয়ে গেলেও তিনি গুনাহগার হবেন। (মুসলিম, হাদিস : ৬৭৩; বাদায়িউস সানায়ে : ১/১৫৮)
৫. জানাজা নামাজ : জানাজার নামাজ ফরজে কেফায়া। যেকোনো একদল মানুষ তা পড়লে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায়। সুতরাং কারাবন্দি ব্যক্তির ওপর জানাজার নামাজ ফরজ নয়। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে অনুমতি দিলে সে তাতে জানাজার নামাজে অংশ নিতে পারবে। জেলখানায় যদি কোনো মুসলমান মারা যায় এবং জানাজা পড়ার মতো অন্য কোনো মুসলমান না থাকে, তবে সুযোগ পেলে বন্দি মুসলমানের জন্য জানাজা পড়া আবশ্যক।
(আদ দুররুল মুখতার : ১/৫১৭)
আল্লাহ সবাইকে দ্বিনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন