আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সম্পর্কের অবনতি একটা সময় চিন্তাই করা যেত না। কারণ, ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান কাবুলের ক্ষমতায় ফেরার পর পাকিস্তান ভেবেছিল, তাদের পুরোনো মিত্ররা এবার ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হবে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) তালেবান আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু সেই সম্পর্ক এখন প্রায় ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি পাকিস্তান প্রথমবার কাবুলে বিমান হামলা চালায়, যা দুই দেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রার উত্তেজনা তৈরি করেছে।
পারস্পরিক প্রত্যাশার ফারাক
২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান দ্বৈত কৌশল নিয়েছিল— একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত আফগান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, অন্যদিকে নিজ ভূখণ্ডে তালেবানদের পুনর্গঠনে সহায়তা করেছিল। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় উভয় পক্ষের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সক্ষমতার অবমূল্যায়ন- এ দুটি বিষয় এ দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে পুনর্গঠনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ
পাকিস্তানের নিরাপত্তা নীতির মূল নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনী ও আইএসআই-এর হাতে। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে পাকিস্তান জুড়ে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)–এর হামলা বেড়েছে। শুধু ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে ২ হাজার ৪০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন, যা গত বছরের পুরো মৃত্যুর সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
পাকিস্তান দাবি করছে, টিটিপির নেতৃত্ব আফগানিস্তান থেকে হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু তালেবান বলছে, টিটিপি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, যার সমাধান ইসলামাবাদকেই করতে হবে।
২০২২ সালে তালেবান সরকার মধ্যস্থতা করে টিটিপি ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে আলোচনা ও অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি করাতে সক্ষম হলেও তা পরে ভেঙে যায়।
তালেবান সরকারের বাস্তবতা
আফগানিস্তানের তালেবান সরকার এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। এখন পর্যন্ত কেবল রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে চীন, ভারত ও ইরানসহ কয়েকটি দেশ তাদের প্রতিনিধিদের স্বাগত জানিয়েছে।
আল-জাজিরার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশটি মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্যাভাব ও মানবিক বিপর্যয়ে ভুগছে। জাতিসংঘের তহবিল কমে যাওয়ায় সাধারণ আফগানরা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবার সংকটে পড়েছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে।
অতীতের বন্ধুত্বে ফেরা কতটা সম্ভব?
এ মুহূর্তে উভয় দেশই কঠোর অবস্থানে রয়েছে। পাকিস্তান এখন তালেবান সরকারকে “রেজিম” হিসেবে উল্লেখ করছে এবং আফগানিস্তানে “অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার” গঠনের আহ্বান জানাচ্ছে। ইসলামাবাদ হুঁশিয়ারি দিয়েছে— তালেবান যদি টিটিপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, তবে আফগান ভূখণ্ডে আরও হামলা চালানো হতে পারে।
তবে পাকিস্তান সামরিকভাবে অনেক শক্তিশালী এবং উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র ও কূটনৈতিক প্রভাব রাখে। সাম্প্রতিক ভারতের সঙ্গে মে মাসের সংঘাতে কয়েকটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবিও করেছে তারা।
অন্যদিকে, তালেবান মনে করে, তারা বিশ্বশক্তির বিরুদ্ধে জয়ী যোদ্ধা; প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত তাদের কাছে তুলনামূলক ছোট লড়াই।
সীমান্ত বন্ধ, বাণিজ্যে ক্ষতি
চামান সীমান্তে চলমান সংঘর্ষে আফগান ও পাকিস্তানি উভয় বণিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আফগানিস্তান স্থলবেষ্টিত দেশ, ফলে তাদের বাণিজ্য মূলত পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সীমান্ত বন্ধ থাকায় দুই দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। তালেবান সরকারের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও আধুনিক অস্ত্র নেই, ফলে পাকিস্তানের হামলার জবাব দিতে তারা অক্ষম।
শান্তির সম্ভাবনা ও মধ্যস্থতা
পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সমস্যা আংশিকভাবে ভারতের সঙ্গে সংঘাতের অংশ হিসেবে দেখছে। তারা দাবি করছে— টিটিপি ভারতীয় সমর্থন পাচ্ছে, যদিও প্রমাণ দেয়নি।
অন্যদিকে, তালেবান ও টিটিপির মধ্যে দীর্ঘদিনের আদর্শিক ও সামাজিক বন্ধন রয়েছে, যা বিচ্ছিন্ন করা কঠিন।
তালেবান নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহ্বান জানান, তাহলে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠবে। কারণ টিটিপির পাশাপাশি পাকিস্তানের অনেক ধর্মীয় গোষ্ঠীও তালেবানদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
এ অবস্থায় সম্ভাব্য উত্তেজনা প্রশমনে কাতার ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর মধ্যস্থতা সবচেয়ে কার্যকর হতে পারে।
সম্প্রতি ভারতের নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি জানিয়েছেন, কাতার ও সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় তালেবান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা বন্ধ রেখেছে।
তবে সবকিছুর পূর্বশর্ত— দুই দেশের নেতাদের মধ্যে প্রকৃত শান্তির ইচ্ছা থাকা।
উপসংহার
আফগান ও পাকিস্তানি নেতৃত্ব দুজনেই জানে— নতুন যুদ্ধ উভয় দেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হবে। তবুও আগের ঘনিষ্ঠতা দ্রুত ফিরে আসবে, এমন আশা করা অবাস্তব। ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থান দুই দেশকে পরস্পরের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। এখন প্রয়োজন, সংঘাত নয়, সহযোগিতা ও পারস্পরিক আস্থার নতুন সূচনা।
সূত্র: আল জাজিরা
লেখক: হামিদ হাকিমি
বিডি প্রতিদিন/আশিক