নিউইয়র্ক সিটির পার্ক অ্যাভিনিউতে অবস্থিত ব্ল্যাকস্টোন ও এনএফএল’র সদর দফতরে ২৮ জুলাই সোমবার বিকেলে সশস্ত্র বন্দুকধারির নির্বিচার গুলিতে বাংলাদেশি আমেরিকান পুলিশ অফিসার দিদারুল ইসলামসহ (৩৬) চারজনের প্রাণহানি ঘটেছে। আরও কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। একপর্যায়ে ৩৪ তলাবিশিষ্ট ভবনটির ৩৩তলায় ওঠে বন্দুকধারী আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশ জানায়।
নিউইয়র্ক পুলিশের কমিশনার জেসিকা এস টিশ সংবাদ সম্মেলনে জানান, নিহত পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম ছিলেন ব্রঙ্কসের ৪৭ নম্বর প্রিসিংটের সদস্য। ঘটনার সময় তিনি পার্ক অ্যাভিনিউয়ের সেই ভবনের নিরাপত্তার কাজে ছিলেন। পরনে ছিল পুলিশের পোশাক। তাঁর বাড়ি বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায়। স্ত্রী এবং দুই শিশু পুত্রের জনক দিদারুল সাড়ে তিন বছর আগে নিউইয়র্ক পুলিশের ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট ছেড়ে পুলিশ বিভাগে অফিসার হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী বর্তমানে ৮ মাসের অন্তসত্ত্বা।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কমিশনার জানান, বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে একটি গাড়ি এসে থামে ভবনের সামনে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন শেন তামুরা নামের এক ২৭ বছর বয়সী যুবক, যার পরনে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং হাতে ছিল এম৪ অটোম্যাটিক রাইফেল। ভবনের ভিতরে ঢুকেই তিনি গুলি চালায়। প্রথমে লবির নিরাপত্তাকর্মী দিদারুল ইসলামকে গুলি করে ফেলে দেয় এবং পরে সাধারণ লোকজনের দিকে, পরে লিফট ব্যবহার করে ভবনের ৩৩ তলায় উঠে সেখানে আরও কয়েকজনকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এবং একপর্যায়ে নিজের বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা করেছে সে।
পুলিশ আরো জানায়, তার গাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় আরও অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ব্যক্তিগত ব্যাগ। তার মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল। তবে হামলার উদ্দেশ্য কী ছিল এবং কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল কি না, সে বিষয়ে এখনো তদন্ত চলছে। পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, সে লাসভেগাস থেকে ২৫২১ মাইল বিএমডব্লিউ গাড়ি চালিয়ে নিউইয়র্কে এসেছিল। এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত (মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টা) হত্যাকান্ডের মোটিভ সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তারা কিছুই জানতে পারেননি। শীঘ্রই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সর্বশেষ পরিস্থিতি উপস্থাপন করা হবে সিটি প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
নিউইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামস সোমবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দিদারুল ইসলাম বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়ে এসে নিউইয়র্কে থিতু হয়েছিলেন। তিনি তার বাবা-মার একমাত্র সন্তান। ঘটনার পরই দিদারের পরিবারের সঙ্গে দেখা করার কথা জানিয়ে মেয়র বলেন, আমরা যাদের সঙ্গেই কথা বলেছি, তারা সবাই বলেছেন, তিনি (দিদার) ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ, যিনি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতেন এবং চেষ্টা করতেন খোদাভক্ত একজন মানুষের মত জীবনযাপন করতে।
আর পুলিশ কমিশনার জেসিকা এস টিশ বলেছেন, যা করার কথা, তিনি তাই করছিলেন। নিজের জীবন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন, চূড়ান্ত আত্মত্যাগ করেছেন। ঠান্ডা মাথায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তার পরনে ছিল সেই পোশাক, যা শহরের প্রতি তার অঙ্গীকারের প্রতিনিধিত্ব করছিল। যেভাবে তিনি জীবন কাটিয়েছেন, সেভাবেই মৃত্যুবরণ করেছেন ‘একজন নায়ক হিসেবে’।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই হামলায় এক হামলাকারীই জড়িত ছিল এবং ভবনটি বর্তমানে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে বিশ্বের রাজধানী খ্যাত নিউইয়র্ক সিটির ব্যস্ততম ও অভিজাত এলাকায় নিরাপত্তা বেষ্টিত একটি ভবনের সামনে গাড়ি পার্ক করে মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে কীভাবে দুর্বৃত্তটি ভেতরে ঢুকলো-সে প্রশ্ন অনেকের। ভবনের ভেতরে প্রবেশের আগেও রয়েছে নিরাপত্তা প্রহরি এবং ম্যাগনেটিক ডোর। কোনকিছুই তাকে আটকাতে পারেনি।
ভবনের নিরাপত্তা ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, এক ব্যক্তি একটি পার্ক করা বিএমডব্লিউ গাড়ি থেকে নেমে এম৪ রাইফেল হাতে নিয়ে ভবনের দিকে এগিয়ে যায়। ভবনে ঢুকেই সে পুলিশ কর্মকর্তার ওপর গুলি চালায় এবং নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করা এক নারীকে গুলি করে। এরপর লবিতে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে।
পুলিশ জানায়, বন্দুকধারী পরে এলিভেটরের দিকে যায় এবং নিরাপত্তা ডেস্কের পেছনে লুকিয়ে থাকা এক নিরাপত্তাকর্মী ও লবিতে থাকা আরও একজনকে গুলি করে। এরপর সে ভবনের ৩৩ তলায় উঠে একটি রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানে গিয়ে একজনকে গুলি করে হত্যা করে এবং পরে নিজেও গুলিতে আত্মহত্যা করে। ৩৩ তলায় উঠার জন্যে লিফটে প্রবেশের সময় একজন নারীকে সে সরে যেতে দেয়। নারীটিকে গুলি করার চেষ্টা দূরের কথা কটু কথাও উচ্চারণ করেনি। এ হামলায় আগত হয়েছে অন্তত ৬ জন।
পুলিশ জানায়, বন্দুকধারীর গাড়ি থেকে একটি রাইফেল কেস, একটি রিভলভার, গুলি ও ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ভবনটিতে দেশের শীর্ষ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ন্যাশনাল ফুটবল লিগের (এনএফএল) অফিস রয়েছে।
বন্দুকধারী ফুটবল প্রেমী ছিলো এবং লাসভেগাসে একটি জুয়া খেলার হোটেলে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করতো। তার বন্দুকের লাইসেন্স ছিল।
দিদারুল ইসলামের মৃত্যুতে নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে নেমে এসেছে গভীর শোক ও উদ্বেগের ছায়া। অনেকে তার ব্রঙ্কসের বাসায় যেয়ে দিদারুলের শোক-সন্তপ্ত মা-বাবাকে শান্তনা দেন। নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে কর্মরত কয়েক শত বাংলাদেশি কর্মকর্তার সকলেই শোকে আচ্ছন্ন। বাংলাদেশি আমেরিকান পুলিশ অফিসার অ্যাসোসিয়েশন তথা বাপা এক বিবৃতিতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে এবং দিদারুলের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল