জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি দেশে নতুন সংকটের শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানো হয়েছে। এ অবস্থায় জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার কান্ডারি হিসেবে পথ দেখাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর দেখানো পথে যদি রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় আসতে পারে তাহলেই জুলাই বিপ্লব পৌঁছাবে কাঙ্ক্ষিত বন্দরে। আর তা না হলে বাংলাদেশ আবার একটি এক-এগারোর মতো কিংবা তার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থায় পড়বে। এই সংকট থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে এবং দেশকে রক্ষা করতে গত রবিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে উপস্থিত হন ড. ইউনূস। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের এই জটিল সংলাপে নীতিনির্ধারণী পথ নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন তিনি। তাঁর এই বক্তব্য কেবল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য নয়, এদেশের জনগণের মুক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা এবং নির্বাচনের অপরিহার্যতা বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের মর্মার্থ কি অনুধাবন করতে পেরেছে রাজনৈতিক দলগুলো? যদি পেরে থাকে তাহলে তা হবে এ সময়ের সবচেয়ে বড় সুখবর। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর দৃশ্যমান আচরণে এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশই ড. ইউনূসের বক্তব্যের সুদূর প্রসারী তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেনি। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পরও নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
জাতীয় সনদের ভিত্তিতে পিআর পদ্ধতিতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, জুলাই গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান করা, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসরদের বিচার- এ পাঁচ দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে নামছে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা ইসলামি দলগুলো। এরই অংশ হিসেবে গত সোমবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও খেলাফত মজলিস কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কর্মসূচিতে রয়েছে- ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল, ১৯ সেপ্টেম্বর দেশের সব বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ মিছিল এবং ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের সব জেলা উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল। এর আগে রবিবার একই কর্মসূচি ঘোষণা করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
প্রশ্ন হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা যখন চলমান, তখন এই কর্মসূচি কি আলোচনাকে জটিল করে তুলবে না?
এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমাদের জানতে হবে প্রধান উপদেষ্টা গত রবিবার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে কী বলেছিলেন। ড. ইউনূস বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে মহোৎসবে নির্বাচন হবে এবং জাতির সত্যিকার নবজন্ম হবে। এটা শুধু নির্বাচন না, এটা নবজন্ম। এত ত্যাগ, রক্ত-আত্মাহুতি সার্থক হবে যদি আমরা নবজন্মটা লাভ করতে পারি।’ তিনি বলেন, ‘এখান থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। যে সমঝোতার রাস্তা শুরু করেছি, তা থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ সমঝোতায় আসতেই হবে। আমি হয়তো গায়ের জোরে বলছি, কিন্তু কথাটা ফেলে দেওয়ার উপায় নেই। জাতি হিসেবে আমাদের নবযাত্রার সুযোগ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দিয়ে গেল, তার একমাত্র সমাধান হলো সমঝোতার পথে গিয়ে নতুন বাংলাদেশ তৈরি করা।’ নীতিনির্ধারণী এবং গুরুত্বপূর্ণ এই ভাষণে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বলে সতর্ক করেন যে ‘আমরা নানান যুক্তি দিতে পারি। যুক্তির কোনো শেষ নেই। কিন্তু সমাধানের পথে থাকতে হবে। অনেকের মনে হয়তো কষ্ট হবে, কষ্ট হলেও মেনে নিচ্ছি। কিন্তু পরে শান্তি পাবেন, দেশ শান্তি পাবে বলে। কারণ দেশের শান্তি বড় শান্তি। আমরা বিতর্কের মধ্যে থেকে গেলে, তা কখন বিস্ফোরিত হবে। বিতর্কের মধ্যে থেকে কে কোনদিকে চালু করে দেবে, এটার কোনো ঠিক নেই।
ড. ইউনূসের এ বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ঐক্যে শান্তি আর বিভেদে বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণ শুধু নির্বাচন বানচাল করবে না, আমাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলবে।
ড. ইউনূস কেবল প্রধান উপদেষ্টা নন। তিনি একজন দূরদর্শী চিন্তাবিদ। একজন নোবেলজয়ী। বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত। মনে রাখতে হবে, শান্তিতে নোবেলজয়ী এই বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে আমরা সম্মিলিতভাবে বর্তমান দায়িত্ব দিয়েছি। তিনি এই দায়িত্ব নিতে চাননি। কিন্তু দেশের মানুষের জন্য, জুলাই বিপ্লবের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ড. ইউনূসের দায়িত্ব তাই, আর দশজন সরকারপ্রধানের মতো নয়। তাঁর প্রধান দায়িত্ব, শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার পথনির্দেশ তৈরি করা। নতুন বাংলাদেশ গড়ার নকশা প্রণয়ন করা। এমন একটি বাংলাদেশের সূচনা যেখানে নতুন করে কোনো স্বৈরশাসকের জন্ম হবে না। জনগণের অধিকার হরণ করা হবে না। আর এ কারণেই দায়িত্ব গ্রহণ করে ড. ইউনূস তিনটি অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেন। এগুলো হলো- ১) জুলাই গণহত্যা বিচার। ২) রাষ্ট্র সংস্কার। ৩) নির্বাচন।
এই তিনটি কাজ একসঙ্গে করা অত্যন্ত কঠিন। পৃথিবীর কোনো দেশই বিপ্লবের পর একসঙ্গে এমন ত্রিমুখী উদ্যোগ নিতে পারেনি। আমরা সবশেষ নেপালের দিকে তাকাতে পারি। বাংলাদেশের তরুণদের বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হয়ে নেপালের জেন-জিরাও সেদেশের সরকারের পতন ঘটাল। কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটল না। নির্বাচনের পথে এগুলো। বিপ্লবে অংশ নেওয়া তরুণরা এখন হতাশ। তারা বলছে, বিপ্লব হাইজ্যাক হয়ে গেছে। এখানেই ড. ইউনূসের বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি কেবল সরকার প্রধান হননি, বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করেছেন। বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করেছেন। নেপাল পুরোনো পথেই হাঁটছে আর আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে যাচ্ছি। তাই, আমরা যদি ড. ইউনূসের লক্ষ্য এবং কার্যক্রম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হই তাহলে আমরা ঠিকভাবে এগোতে পারব না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কিছু রাজনৈতিক দল ড. ইউনূসের চিন্তা ও দর্শন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের স্বার্থের চেয়ে তারা দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
ড. ইউনূস বারবার বলছেন, জুলাই আন্দোলনের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। জুলাই আন্দোলনের ঐক্য বিনষ্ট হওয়া মানেই ফ্যাসিবাদের পুনর্জন্ম। এখন যদি কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আন্দোলন শুরু করে তাহলে পতিত স্বৈরাচার আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। দেশে সৃষ্টি হবে বিশৃঙ্খলা। নির্বাচন বানচাল হলে দেশে আরেকটি অনভিপ্রেত পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
দেশের পরিস্থিতি এমনিতেই খারাপ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। অর্থনীতি সংকটে। সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের বাংলাদেশকে নিয়ে প্রশ্ন বাড়ছে। এসব বাস্তবতা আমলে নিয়েই প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন। তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন। এ কারণেই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন।
আমাদের একটা কথা উপলব্ধি করতে হবে, ড. ইউনূসের ক্ষমতার লোভ নেই। তিনি যা করছেন তা দেশের মানুষের জন্য, শান্তির জন্য।
রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে এখন দুটি বিকল্প। তারা তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে দেশের স্বার্থে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে। মহোৎসবের নির্বাচনে অংশ নেবে।
অথবা, তারা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে হানাহানি করে নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দেবে বাংলাদেশকে।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতি অনুরোধ, দেশটাকে সংঘাতের পথে ঠেলে দেবেন না। দেশের স্বার্থে ড. ইউনূসের কথা শুনুন। সবাই মিলে দেশটাকে আসুন বাঁচাই।