দুর্নীতিই যেন একমাত্র সাধনা ছিল সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদারের। দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি করেছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পাঁচ বছরের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন নওগাঁর ধান ব্যবসায়ী সাধনচন্দ্র মজুমদার। তিনি মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবাও ছিলেন একজন ধানের ব্যবসায়ী। ধান-চালের ওই আড়তের ব্যবসা দিয়েই চলেছে নয় ভাইবোনের বড় সংসার।
সেই সাধনচন্দ্র শেখ হাসিনার ছাতায় ভর করে মন্ত্রিত্ব নিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন। সাড়ে পাঁচ বছরের মন্ত্রিত্বকালে ঘুষ, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন সাধনচন্দ্র মজুমদার।
নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে তিনি হয়ে যান খাদ্যমন্ত্রী। খাদ্য মন্ত্রণালয়কে বানিয়ে ফেলেন টাঁকশাল। খাদ্য মন্ত্রণালয়কে ঘুষ, দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন সাধনচন্দ্র মজুমদার।
মন্ত্রিত্ব পেয়েই নিজের ভাতিজা রাজেশ মজুমদার, ছোট ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা, ছোট মেয়ে তৃণা মজুমদার এবং দুই জামাতা আবু নাসের বেগ ও নাসিম আহম্মেদকে নিয়ে গড়ে তোলেন দুর্নীতির দুর্ভেদ্য সিন্ডিকেট। টাকার বিনিময়ে সব ‘অসাধ্যসাধন’ হতো মন্ত্রী সাধনচন্দ্রের দপ্তরে।
১৮ কোটি মানুষের এ দেশে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের রয়েছে খাদ্য মজুত ও জোগানের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। যেখানে খাদ্য বিভাগের প্রতিটি পদ অত্যন্ত লোভনীয়। প্রতিটি পদায়নে অন্তত ৩০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ কোটি টাকা পর্যন্ত নিলাম উঠত সাধনের রাজত্বে। লোভনীয় পদের মধ্যে ছিল আরসি ফুড (রিজিওনাল কন্ট্রোলার অব ফুড), ডিসি ফুড (ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার) এবং ওসি এলএসডি (গুদাম কর্মকর্তা)।
এ ছাড়া ধান-চাল বেশি উৎপাদন হয় এমন তালিকাভুক্ত জেলার বাইরেও যে কোনো স্থান ও পদে পদায়নের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতে হতো সাধন সিন্ডিকেটকে। খাদ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন এসব তথ্য। ঘুষ, দুর্নীতির সব অপকর্ম সমন্বয় করতেন মন্ত্রীর ভাতিজা রাজেশ মজুমদার। তিনি ছিলেন খাদ্যমন্ত্রীর সহকারী; বসতেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ে। সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রীর একান্ত সচিব সাধনচন্দ্রের বড় জামাতা আবু নাসের বেগ (মাগুরার সাবেক ডিসি) ও মন্ত্রীর এপিএসের দায়িত্বে থাকা ছোট মেয়ে তৃণা মজুমদার। টাকার বিনিময়ে দপ্তরের যে কোনো পদায়ন, বদলি, বরাদ্দ সবকিছু মন্ত্রণালয়ে বসে তাঁরাই সামলাতেন। টাকার লেনদেন হতো মন্ত্রীর বেইলি রোডের সরকারি বাসায়। সেই বাসভবন সন্ধ্যা থেকেই খাদ্য বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার পদভারে মুখর থাকত। প্রায় প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে দরদাম ঠিক করে পছন্দমাফিক বদলি কিংবা পদায়ন নিতেন খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। সাধন সাম্রাজ্যের বেশ কয়েকজন সেনাপতি ছিলেন। সাধন মজুমদার শুধু স্বাক্ষর করে বক্তৃতা করে যেতেন। তাঁর সেনাপতিরা দেনদরবার করে টাকা হাতিয়ে নিয়ে মন্ত্রীর কোষাগারে জমা দিতেন। অভিযোগ রয়েছে, কমিশন বুঝে নিয়ে কাগজে স্বাক্ষর করতেন। টাকা সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন তাঁর ভাতিজা রাজেশ মজুমদার।
রাজেশ ছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অলিখিত জুনিয়র মন্ত্রী। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের বদলিবাণিজ্য, চাল-গম কেনায় নয়ছয়ের মূল মাস্টারপ্ল্যানার। মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে তিনিও সুযোগ পেয়ে গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ। মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম রাজেশ করলেও নওগাঁ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক মন্ত্রীর ছোট ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা ও মেয়েজামাই নওগাঁ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহম্মেদ।
নওগাঁ জেলা থেকে মন্ত্রণালয়ের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন (একান্ত সচিব) আবু নাসের বেগ। একজন এপিএসের দায়িত্ব পালন করতেন ছোট মেয়ে তৃণা মজুমদার। এ পাঁচজনই ছিলেন মূলত সাবেক মন্ত্রী সাধন মজুমদারের নিজস্ব লোক।
এ কজন মিলে পদায়ন, বদলি, বরাদ্দ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন। অর্থের লেনদেন হতো ঢাকায় বেইলি রোডে। দরদাম ঠিক করে পদায়ন নিয়েছেন কয়েকজন খাদ্য কর্মকর্তা। প্রতিটি পদায়নে সর্বনিম্ন ৩০ লাখ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হতো।
গত ৫ আগস্টের আগে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে বগুড়ায় যোগদান করেন এক কর্মকর্তা। একাধিক সূত্রমতে তিনি ১ কোটি টাকা লেনদেন করে বগুড়ার চেয়ারটি পান। এ কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, গাইবান্ধা, রংপুরসহ কয়েকটি জেলার খাদ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘুষ হিসেবে কমিশন সংগ্রহ করে দেওয়া। এ কমিশন চলে যেত সাবেক মন্ত্রীর কোষাগারে। দেশের চালের অন্যতম মোকাম হিসেবে পরিচিত উত্তরের জেলা নওগাঁ। এখানে সামান্য হেরফের হলেই নড়েচড়ে বসে চালের বাজারদর। অথচ এ জেলায়ই বিভিন্ন গুদামে হতো অবৈধভাবে ধান-চাল মজুত।
মিলারের বেশির ভাগই সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদারের আত্মীয়। বাজার সিন্ডিকেট তৈরি করতে নওগাঁর গুদামগুলোয় অবৈধভাবে ধান-চাল মজুত করতেন তাঁরা। হঠাৎ ধান-চালের দাম বাড়িয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন সিন্ডিকেটে তাঁর আত্মীয়রা।
নওগাঁ জেলার চাল ব্যবসায়ী মানিক প্রামাণিক জানান, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার ক্ষমতায় থাকাকালে বড় বড় মিলাররা গোডাউনে হাজার হাজার টন পুরোনো চাল ও ধান মজুত করে রাখতেন। তাঁদের সিন্ডিকেটের কারণেই চালের বাজারে কখনই অস্থিরতা কাটেনি। এসব করে তাঁরা সে সময় শত শত কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন।
গম, চালসহ খাদ্যপণ্য আমদানিতে রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন সাবেক মন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার। পছন্দের লোক দিয়ে গোপনে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ছাপানোসহ নিজস্ব লোককে সেই টেন্ডার পাইয়ে দিতেন। সরকারিভাবে সংগ্রহের চাইতে বিদেশ থেকে আমদানিতেই বেশি আগ্রহ ছিল তাঁর। এসব কর্মকাণ্ডে তাঁকে সহযোগিতা করতেন সোহেল নামে এক ঠিকাদার। ‘গম সোহেল’ নামেই যাঁর পরিচিতি গোটা খাদ্য বিভাগে। এভাবেই হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধনচন্দ্র মজুমদারের পেটে ছিল খাদ্য বিভাগ।
জানা গেছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত অর্থবছরে ১০ লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেখানে রাশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে সরাসরি ৬ লাখ টন গম আমদানি করা হয়। আর ৪ লাখ টন গম ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে কেনা হয়। তবে অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, সিরাজগঞ্জের ন্যাশনাল ইলেকট্রিক নামে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক সোহেল ওরফে গম সোহেল রাশিয়া থেকে গম এনে সরকারি গুদামে সরবরাহ করতেন। এ গম সোহেল মূলত মন্ত্রী সাধন মজুমদারের লোক ছিলেন। ওপেন টেন্ডারের কথা বলা হলেও এসব গম আমদানি করতেন শুধু গম সোহেলই।
অন্য কোনো ঠিকাদার টেন্ডারে অংশ নিলেও কাজ যেত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইলেকট্রিকের ঘরে। সেখান থেকে মুনাফা নিতেন গম সিন্ডিকেটের হোতা মন্ত্রীর জামাতা পাইলট শুভন দেব। এ শুভন দেব দিনাজপুর খাদ্য গুদামের এক ম্যানেজারকে কোটি টাকার বিনিময়ে ঢাকার তেজগাঁও সিএসডিতে পদায়ন করান।
এভাবেই খাদ্য মন্ত্রণালয় মন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার বানিয়ে ফেলেছিলেন দুর্নীতির গুদাম। নিজের লোকজনের মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে পাঁচ বছর করেন সীমাহীন দুর্নীতি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতিই ছিল সাধনের নীতি।