জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষ্য দিয়েছেন মাইক্রোবাস চালক খোকন চন্দ্র বর্মণ। পুলিশের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত চেহারা নিয়ে গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তিনি নিজের জবানবন্দি তুলে ধরেন। ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত নিজের সামনে পুলিশের গুলিতে একাধিক ব্যক্তি নিহত হওয়ার বর্ণনা দেন তিনি। ২৩ বছর বয়সি খোকন চন্দ্র বর্মণ
বলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিতে এসেছি আমার সামনে হওয়া হত্যা এবং নিজের প্রতি যে অন্যায় হয়েছে সে বিষয়ে। ৫ আগস্ট দুপুরের পর যখন খবর আসে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, তখন সেনাবাহিনী চলে যায়। ওই সময় পুলিশ থানা থেকে বেরিয়ে পাখির মতো গুলি করে। ওই সময় মাথায় টার্গেট করে করা এক পুলিশ সদস্যের গুলি তার মাথায় লাগে। এক চোখ ও নাক নষ্ট হয়ে যায়। বিকৃত হয়ে যায় মুখমণ্ডল।
জবানবন্দি শেষে এই সাক্ষীকে জেরা করেছেন পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। আজ আরও দুই সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন। বেলা ১১টা ১০ মিনিটে শেখ হাসিনার বিচারে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে বক্তব্য তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি শেখ হাসিনাসহ দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান। এরপর সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতা ধরে রাখা। তিনি ছিলেন এসব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু বা নিউক্লিয়াস। অন্যান্য আসামি তার অধীনে থেকে বুঝতেন যে, শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার ওপরই তাদের নিরাপত্তা ও পুরস্কার নির্ভর করছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের পরিবারের ওপর তথ্যচিত্র এবং সাক্ষী খোকন বর্মণের গুলি খাওয়ার পরের দৃশ্যসংবলিত ভিডিও ক্লিপ এজলাসে প্রদর্শন করেন চিফ প্রসিকিউটর। সূচনা বক্তব্য পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন। চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের ফেসবুক পেজেও সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সূচনা বক্তব্য শেষে সাক্ষীর নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে সম্প্রচার বন্ধ করতে বলেন চিফ প্রসিকিউটর। এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল কিছু সময়ের জন্য বিরতিতে যান। দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে এজলাসে ওঠেন তিন বিচারক। ১২টা ৪৫ মিনিটে শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। গতকাল ট্রাইব্যুনালে আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
একজনের বুকে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায় : গত বছর ১৯ জুলাই নিজের সামনে একজনের মৃত্যুর ঘটনা তুলে ধরে খোকন বর্মণ বলেন, ১৮ জুলাই থেকে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় আমি আন্দোলনে যোগ দিই। ১৯ জুলাই সকালে নারায়ণগঞ্জের ভূঁইঘর থেকে জালকুঁড়ির দিকে যাই। সেখান থেকে চাষাঢ়ার দিকে যাচ্ছিলাম। ক্যাম্পের সামনে বিজিবি ও পুলিশ আমাদের দিকে গুলি করে। আমার চোখের সামনে এক ভাইয়ের বুকে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। আরও অনেকে আহত ও নিহত হন।
গরু জবাই করার মতো রক্ত বের হচ্ছিল : গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন একজনের মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে খোকন চন্দ্র বর্মণ জবানবন্দিতে বলেন, সকাল ৯টার দিকে সোনালী মার্কেট আমার বাসা থেকে আন্দোলনের জন্য সাইনবোর্ড এলাকায় আসি। সেখান থেকে আমরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই। বিজিবি-পুলিশ আমাদের বাধা দেয়। মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে আমাদের ঢাকার দিকে যেতে দেওয়া হয়। যাত্রাবাড়ী এসে দেখি পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করছে। তখন দুপুর ১২টা কি সাড়ে ১২টা বাজে। সামনের দিকে রওনা দিলে পুলিশ আবারও আমাদের দিকে গুলি করে। একটি গুলি একজনের মাথার একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। এমনভাবে রক্ত বের হচ্ছিল যেন গরু জবাই করা হয়েছে। ওই গুলিটি আমাদের আরেকজনের গায়ে লাগলে তিনি আহত হন। যার মাথায় গুলি লেগেছিল তিনি মারা যান।
যেভাবে মুখে গুলি লাগল খোকন বর্মণের : ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে যায় খোকন চন্দ্র বর্মণের। তার বর্ণনা দিয়ে তিনি ট্রাইব্যুনালে বলেন, যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ যখন গুলি করতে থাকে, তার একপর্যায়ে সেনাবাহিনী ফাঁকা গুলি করে তাদের চলে যেতে বলে। এ সময় পুলিশ থানায় চলে যায়। তারপর খবর আসে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। তখন সেখান থেকে সেনাবাহিনী চলে যায়। সেনাবাহিনী চলে গেলে পুলিশ থানা থেকে বের হয়ে পাখির মতো গুলি করতে থাকে। ওই সময় আমরা ফ্লাইওভারের নিচে পিলারের পেছনে আশ্রয় নিই। প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী খোকন বর্মণ বলেন- পুলিশ আমাদের টার্গেট করে গুলি করে। অধিকাংশের গুলি লাগে। দৌড় দেওয়ায় আমার হাত ও পায়ে গুলি লাগে। আমি ফ্লাইওভারের নিচে ড্রামের পেছনে আশ্রয় নিই। এক পুলিশ হয়তো আমার মাথা টার্গেট করে গুলি করেছিল; কিন্তু গুলি লাগে আমার চোখ, নাক এবং মুখে। ছটফট করতে থাকি। শুধু হাত নাড়িয়ে মানুষের সাহায্য চাচ্ছিলাম। আমার বাঁচার কথা ছিল না। ছাত্র ভাইয়েরা প্রথমে মুগদা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠায়। ছাত্ররা আমার পরিবারকেও খবর দেয়। ঢাকা মেডিকেল প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে মিরপুর ডেন্টাল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। ভগবানের কৃপায় আমার চিকিৎসা হয়। আমি বেঁচে যাই।