শুধু বিদেশে নয়, দেশেও পরিবারের সদস্যদের নামে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছিলেন দুর্নীতির বরপুত্র নসরুল হামিদ বিপু। আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধিকাংশ অবৈধ সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছেন এ পলাতক দুর্বৃত্ত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত আগস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে নামে-বেনামে থাকা প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার সম্পদ পাচার করেছেন বিপু।
রাজধানীর গুলশান ক্লাবের ঠিক উল্টো পাশে অনেকটা ফাঁকা পড়ে আছে বড় একটি প্লট। বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী এর দাম অন্তত ২০০ কোটি টাকা। মূল্যবান এ সম্পত্তির মালিক ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। তিন মাস ধরে জায়গাটি বিক্রির চেষ্টা চলছে। যদিও খুঁজে পাওয়া যায়নি কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা। গুলশানের মূল্যবান এ প্লটটির পাশাপাশি রাজধানীর মাদানি এভিনিউর ১০০ ফুট রাস্তার পাশেও নসরুল হামিদের রয়েছে ৫ বিঘা জমি। অনেকটা বাগানবাড়ির আদলে জায়গাটি গড়ে তুলেছেন তিনি। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে বিপু সেখানে নিয়মিত আড্ডা দিতেন। সম্প্রতি এ জমিটিও বিক্রির জন্য ক্রেতা খোঁজা হচ্ছে। প্রতি কাঠা ২ কোটি করে ধরলেও সম্পত্তিটির মূল্য ২০০ কোটি টাকা। তবে এত বড় জায়গা একসঙ্গে কেনার মতো গ্রাহক না পাওয়ায় ছোট প্লট আকারে বিক্রির তৎপরতা চালাচ্ছে নসরুল হামিদের কোম্পানি হামিদ রিয়েল এস্টেট।
বড় আয়তনের এ দুটি প্লট বিক্রি করতে না পারলেও গুলশান, বনানী ও নিকেতন এলাকার একাধিক ছোট প্লট ও বাড়ি এরই মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন নসরুল হামিদ। সম্পত্তি বিক্রির ওই টাকার বড় অংশই তিনি হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে নিয়ে গেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। দেশের হুন্ডি তৎপরতার খোঁজখবর রাখেন এমন একজন ব্যবসায়ী জানান, নসরুল হামিদসহ আওয়ামী লীগের পলাতক এমপি-মন্ত্রীদের বড় অংশ তাদের সম্পত্তি বিক্রির টাকা ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডায় সরিয়ে নিচ্ছেন। আগে থেকেই ওইসব দেশে তাদের বাড়ি-গাড়ি রয়েছে। স্ত্রী ও সন্তানরাও সেখানে বসবাস করে আসছিলেন। নসরুল হামিদের দুই সন্তানও বিদেশে থাকেন। এক দশকের বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন নসরুল হামিদ বিপু। মন্ত্রণালয়টির মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিগত দেড় দশকে সরকারের সবচেয়ে বেশি অর্থের অপচয় ও লুটপাট হয়েছে এ মন্ত্রণালয় ঘিরে। নিজের ব্যবসা ও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থে নসরুল হামিদ বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানেও তার সম্পত্তি ও ব্যবসা রয়েছে। নসরুল হামিদের পৈতৃক ব্যবসা ছিল জমি বেচাকেনা তথা রিয়েল এস্টেটের। তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হামিদ গ্রুপ। এ গ্রুপের অধীনে হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, হামিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড, হামিদ ইকোনমিক জোন, হামিদ ফ্যাশন লিমিটেড অ্যান্ড হামিদ সোয়েটার লিমিটেড ও হামিদ অ্যাগ্রো লিমিটেডের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। হামিদ গ্রুপের রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ব্র্যান্ড হলো ‘প্রিয়প্রাঙ্গণ’। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদে রয়েছেন নসরুল হামিদ বিপুর ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু। বিপুর মতো তিনিও বর্তমানে পলাতক।
হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘নসরুল হামিদ বিপু ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের পরিমাণ অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবসা সচল ছিল। কিন্তু এরপর থেকেই পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হয়েছে। বেশ কিছু কর্মীকে এরই মধ্যে ছাঁটাই কিংবা ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। কোম্পানির রিয়েল এস্টেট ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। বেশ কিছু জমি এরই মধ্যে বেদখল হয়ে গেছে।’ হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের আওতায় রাজধানীর কেরানীগঞ্জে প্রিয়প্রাঙ্গণ-১ ও প্রিয়প্রাঙ্গণ-২ আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আবাসিক এলাকাটিতে নগদ ও কিস্তিতে প্লট বিক্রি করছে হামিদ গ্রুপ। আবাসিক এলাকাটির প্রতিষ্ঠাকালীন জোরপূর্বক জমি কিনে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আবার বাজারমূল্যের চেয়ে কমেও জমি বিক্রিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন কেউ কেউ। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কসংলগ্ন আবাসিক এলাকা প্রিয়প্রাঙ্গণ-২। সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় এটি গড়ে তোলা হয়েছে। বড় বিলবোর্ডের মাধ্যমে প্লট বিক্রির বিজ্ঞাপনও রয়েছে। তবে আবাসিক এলাকার রাস্তাঘাট এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি। বসবাস করার মতো সুযোগ-সুবিধাও দেখা যায়নি সেখানে। আবাসিক এলাকার প্রধান ফটকে একজন নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া তেমন কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। রয়েছে কেবল অল্প কয়েকটি নির্মাণাধীন ভবন। বাকি সব প্লটই ফাঁকা পড়ে আছে। প্রিয়প্রাঙ্গণ আবাসিক এলাকায় প্লটের অর্থ পরিশোধের পরও জমি রেজিস্ট্রেশন না দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজে এমন অসংখ্য অভিযোগ করেছেন প্লট ক্রেতারা। তাদের মধ্যে একজন হেমায়েত হোসেন। ২০০৮ সালে প্রিয়প্রাঙ্গণ আবাসিক এলাকায় কিস্তির মাধ্যমে ৩ কাঠার প্লট নিয়েছিলেন। ২০১২ সালে কিস্তির সব অর্থ পরিশোধ করলেও তিনি এখনো প্লট বুঝে পাননি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহের ত্রিশালে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়েছে হামিদ গ্রুপ। উপজেলার নারায়ণপুর ও খাগাদীপাড়া মৌজায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ১৫৩ একর জমিতে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর এটির অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমি কেনার সময়ও বাজারমূল্যের চেয়ে কম অর্থ দেওয়া ও জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। কেরানীগঞ্জ এলাকায় স্থানীয়রা জানান, গত দেড় দশক ধরে নসরুল হামিদের কথাই ছিল কেরানীগঞ্জের আইন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত আট মাসে অনেকেই তাদের বেদখল হওয়া জমি দখলে নিয়েছে। যদিও নসরুল হামিদ এসব জমি প্লট বানিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সূত্র জানায়, দুর্নীতিবাজ নসরুল হামিদ বিপু গণপূর্ত ও গৃহসংস্থানবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও রিহ্যাব সভাপতি থাকাকালে ঝিলমিলের দ্বিতীয় ফেজের শত শত একর জমি দখল করে নিজ আবাসন প্রকল্প ‘প্রিয়প্রাঙ্গণ’ গড়ে তোলেন। এ কারণে কালক্ষেপণের জন্য কৌশলে ঝিলমিল প্রকল্পের নীতিমালা মন্ত্রণালয়ে আটকে দেন। ফলে ঝিলমিল প্রকল্পের প্রথম ফেজের দরখাস্ত সময়মতো আহ্বান করা যায়নি। একই সঙ্গে প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেজ নিয়েও দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। তৎকালীন রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মুহাম্মদ নুরুল হুদা ওই সময় এ বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেন। তিনি জানান, দরখাস্ত আহ্বানের জন্য একটি নীতিমালা প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে রাজউক। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও তা পাস করা হয়নি। রাজউকের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, কেবলমাত্র ঝিলমিল প্রকল্পের প্রথম ফেজই নয়, দ্বিতীয় ফেজের প্রকল্প প্রস্তাবনা ফাইলও মন্ত্রণালয়ে আটকে পড়ে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ইশারায়। কিন্তু ওই সময় এ ব্যাপারে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। ঝিলমিল প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেজের প্রস্তাবিত জমিতেই গড়ে উঠেছে প্রিয়প্রাঙ্গণ। এ প্রকল্পের জন্য রাজউক ১১০০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা জমা দিয়েছিল। এ প্রকল্পে সাড়ে ৩ হাজার প্লট ও ৩০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের কথা রাজউকের। নসরুল হামিদ যে ঝিলমিল প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেজের প্রস্তাবনার জমিতে ঝিলমিল প্রকল্প গড়ে তুলেছেন, তা কর্তৃপক্ষের তদন্তেও উঠে এসেছে। অদৃশ্য কারণে তা বারবার ধামাচাপা পড়ে গেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নসরুল হামিদ বিপুর আবাসন ব্যবসা রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠায় এ ব্যবসার পরিধি আরও বাড়ান। তিনি মেয়ে আলিফা হামিদের নামে গড়ে তোলেন আলিফিয়া রিভার ভিউ প্রকল্প। এ প্রকল্পেও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি।