সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ থাইল্যান্ডে গেছেন। বুধবার দিবাগত রাত ৩টা ৫ মিনিটে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে তিনি দেশ ছাড়েন বলে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। তিনি পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা-কর্মীরা। তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে দেশ ছাড়লেও এত দিন দেশেই ছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করা অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ। অবশেষে তিনিও দেশ ছাড়লেন। তাঁর দেশত্যাগে তোলপাড় শুরু হয়েছে প্রশাসনের ভিতরে ও বাইরে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সাবেক এই রাষ্ট্রপতিকে দেশত্যাগের সুযোগ করে দেওয়ার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগও দাবি করা হয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগের ঘটনায় দায়িত্ব পালনে গাফিলতির কারণ উদঘাটনে অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) মতিউর রহমান শেখকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী এবং ইমিগ্রেশন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহসিনা আরিফকে প্রত্যাহার ও মো. আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জের সদর থানায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আজহারুল ইসলাম এবং এসবির একজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গতকাল বলেছেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগে সহযোগিতা করা কর্মকর্তাদের যদি শাস্তির আওতায় আনতে না পারেন তাহলে নিজেই চলে যাবেন (পদত্যাগ করে দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন)। এ ঘটনায় তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কার ও প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিমানবন্দরের সূত্রগুলো জানায়, আবদুল হামিদের দেশত্যাগে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। নিষেধাজ্ঞা না থাকায় সাবেক এই রাষ্ট্রপতিকে দেশত্যাগে বাধা দেওয়া হয়নি। তিনি চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে গেছেন। আবদুল হামিদের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তাঁর সঙ্গে থাইল্যান্ড গেছেন ছোট ছেলে রিয়াদ আহমেদ ও শ্যালক ডা. নওশাদ খান। দেশের চিকিৎসকদের পরামর্শেই তিনি বিদেশে গেছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ। গতকাল নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার ও বিচার কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। হাসনাত লিখেছেন, ‘খুনিকে দেশ থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, পুলিশ আসামি ধরলেও আদালত থেকে জামিন দেওয়া হয়। শিরীন শারমিনকে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে বাসায় গিয়ে পাসপোর্ট করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল জানুয়ারিতে হওয়ার কথা থাকলেও মে মাসে এসেও শুরু হয়নি। আর আপনারা বলছেন আওয়ামী লীগের বিচার করবেন? তা ইন্টেরিম, এখন পর্যন্ত কী কী বিচার ও সংস্কার করেছেন?’
এ ঘটনার পর এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আবদুল হামিদকে বিমানবন্দরে আটকানো হলো, তারপর নাকি চুপ্পুর (রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন) অফিস থেকে ফোনকল পেয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো। এর পরও কি অন্তর্বর্তী সরকারকে জুলাই বিপ্লবীরা সমর্থন দিয়ে যাবে? স্যরি, হয় চুপ্পুকে সরান এবং আওয়ামী লীগকে ব্যান (নিষিদ্ধ) করেন, আর না হয় নিজেরা সরে যান।’
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে দেশত্যাগের সুযোগ দেওয়ার প্রতিবাদে বাংলাদেশ যুব অধিকার পরিষদ গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয় -বাংলাদেশ প্রতিদিন
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের সময় বেঁধে দিল গণঅধিকার পরিষদ : ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ দেশ ছেড়েছেন প্রধান উপদেষ্টার গ্রিন সিগন্যালে এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সহায়তায়।’ এমন অভিযোগ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। আবদুল হামিদের দেশ ছাড়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে গতকাল সচিবালয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার পর গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে এমন অভিযোগ করেন তিনি।
রাশেদ খান বলেন, আমরা এটা জানি, প্রধান উপদেষ্টার গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সহায়তায় ডামি রাষ্ট্রপতি পালিয়েছেন। এ অবস্থায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের কাছে এ বিষয়ে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। এর আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের দিকে যান গণঅধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা। পরে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়ে স্মারকলিপি দেয়।
স্বরাষ্ট্র ও ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগ দাবি ইনকিলাব মঞ্চের : বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র ও ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগ দাবি জানিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ। গতকাল বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান সংগঠনটির মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদী। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘গণ অভ্যুত্থানের ১০ মাস পরে এসেও আমাদের বলতে হচ্ছে, আপনারা কী করেন? আপনারা চুপ্পুকে (রাষ্ট্রপতি) অপসারণ করতে পারেন নাই, জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে পারেন নাই, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে পারেন নাই, আপনারা ক্ষমতায় বসে করেনটা কী? এয়ারপোর্টে হামিদকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে কে ফোন দিয়েছে তার নাম বলেন?। যদি না বলতে পারেন এই দায় প্রধানত স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার।
হাদী বলেন, জুলাই গণ অভ্যুত্থানের আজকে ১০ মাস পার হয়েছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সরকারের রীতিমতো প্রসব বেদনা থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে তারা ফ্যাসিস্ট হাসিনার রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে রাতের আঁধারে ঢাকঢোল পিটিয়ে পরিবারসহ দেশ ত্যাগের সুযোগ করে দিয়েছে। ছাত্র উপদেষ্টাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনারা যে ক্ষমতায় আছেন এতে লাভ হচ্ছে কার? বরং আপনারা থাকার কারণে অন্য উপদেষ্টারা বলতে পারছেন, আমাদের সঙ্গে ছাত্ররা আছে। আপনাদের বলি, আপনাদের যদি সৎ সাহস থাকে তাহলে আপনারা পদত্যাগ করুন। আপনারা এই বলে পদত্যাগ করুন যে, আমরা জনতার একটা দাবিও এই সরকারকে দিয়ে বাস্তবায়ন করাতে পারি নাই। আমরা সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ নিতে পারি নাই।
প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে হাদী বলেন, জুলাই গণহত্যার বিচার না করে আপনি যত ডেভেলপমেন্ট করবেন, কোনো ডেভেলপমেন্ট আপনাকে জনতার রোষ থেকে বাঁচাতে পারবে না। উন্নয়ন করে যদি কেউ বেঁচে যেত তাহলে খুনি হাসিনার পালানো লাগত না। আপনাকে যাতে ‘জুলাইয়ের গাদ্দার’ বলে ঘোষণা দেওয়া না লাগে সেজন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাই, আর আপনার সহযোগিতা চাই।